প্রবন্ধ রচনা : আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা

আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা

ভূমিকা : প্রকৃতির পালাবদল দিন আসে দিন যায়। জীবন প্রবাহে ঘটে নানা ঘটনা । প্রতিনিয়ত বিস্তৃতির অতল তলে তলিয়ে যায় অনেক ঘটনা। কখনো কখনো এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা চাইলেও ভোলা যায় না। মানুষের জীবনে স্মৃতিময় হয়ে থাকে। আমার জীবনে তেমনি স্মৃতিময় ঘটনা ২০০৮ সালের ১২ জুনের কাল রাত। এটি ছিল একটি ঝড়ের রাত। জীবনে অনেক ঝড়ের কথা শুনেছি, কিন্তু সে রাতে ঝড়ের তাণ্ডবলীলা প্রত্যেক্ষ করেছি আমি । এর কোনো তুলনা হয় না । আমার এ অল্প পরিসর জীবনে এমন বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা আর কখনো হয়নি ।

স্মরণীয় ঝড়ের রাত : বাংলাদেশ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবনের দেশ । এর ফলে প্রতিবছরই ক্ষতি হচ্ছে বাংলার বুক, ধ্বংস হচ্ছে ধন-প্রাণ সবকিছু। এমনই একটি চরম দুঃখের রাত ২০০৮ সালের ১২ জুন। এটি আমার জীবনের একটি বেদনার ইতিহাস, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার রক্তাক্ত হৃদয়ের আহাজারি। এদিন উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্র অঞ্চলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এটি ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ।

ঝড়ের সূচনা : ২০০৮ সালের ১২ জুন সকাল থেকেই শুরু হয় টানা বর্ষণ। ঝড়ো বাতাসসহ বৃষ্টিতে পৃথিবীটা যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিল। দুপুরের দিকে কিছুটা শান্ত হয়ে এল পরিবেশ। দিন শেষে সন্ধ্যা হলো। আকাশের বুক জুড়ে শুধু কালো মেঘের আভাস দেখা যাচ্ছিল। মানুষসহ সকল প্রাণী যেন সৃষ্টিকর্তার দয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় কোনো লোক ছিল না। সন্ধ্যালগ্নে রাখাল গোরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল না। গাছের ডালে বসা পাখির অসহায় আর্তনাদে চারদিকের পরিবেশ যেন এক বিষণ্নতার সৃষ্টি করছিল। আস্তে আস্তে অন্ধকার আরো গারো হয়ে আসছিল। রাস্তাঘাট, গাছপালা কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আকাশে হঠাৎ মেঘের গর্জন শোনা যায়। বাতাসের গতি বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। চারদিকে মেঘের গর্জনের বিকট শব্দ আর শো শো বাতাস যেন মহাপ্রলয়। তার সাথে ২৫ থেকে ৩০ ফিট উঁচু জলোচ্ছ্বাস। রাক্ষুসে ঝড়ের হুংকারে পুরো পৃথিবী কম্পিত। ঘর-বাড়ি, গাছপালা বিকট শব্দ করে ভেঙ্গে পড়ছে। আকাশ ব্যাপি বিদ্যুৎ চমকানো এবং মেঘের গর্জন যেন পৃথিবী লন্ডভন্ড হওয়ার উপক্রম শুরু হলো ।

আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা

ঝড়ের রাতে আমাদের অবস্থা : ঝড়ের রাতে বাবা-মা, ভাইবোন মিলে আমরা সবাই বাড়িতেই ছিলাম। ঝড় শুরু হলে আমরা সবাই আল্লাহকে ডাকছিলাম। মা আমাদের ভাইবোন সবাইকে নিয়ে বসে দোয়া পড়ছিলেন। হঠাৎ ঝড়ের একটি ঝাপটা এসে আমাদের ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমরা সবাই ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমাদের ঘরের ভিতর পানি ঢুকছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার । পানি প্রায় হাঁটু পরিমাণ হয়ে গেল। বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। ঝড়ের সাথে লড়াই করে এবং পানি সাঁতরিয়ে আমরা পাশের একটি দোতলা বাসায় আশ্রয় নিলাম । সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের মতো অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ।

ঝড়ের পর পরিবেশ : ভোরেই আমরা নিচে নেমে এসে দিখে ধ্বংসস্তূপের ওপর সীমাহীন বিরান ভূমি । নিষ্ঠুর ঝড় সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে । যেখানে সেখানে মানুষের লাশ আর গবাদি পশুর মৃত দেহ পরে আছে । তাদেরকে সরানোর মতো কোনো লোক ছিল না। মানুষ আর পশু পাখির চিৎকারে পৃথিবী প্রকম্পিত। স্বজনহারা মানুষ আপন জনের খুঁজে চারদিকে ছোটাছুটি করছে। সেই ঝড়ে আমাদের গ্রামের প্রায় ৪০ জন লোক মারা গিয়েছিল । অনেক বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয়েছিল। ফসলের জমি নষ্ট হয়েছিল।

উপসংহার : আমরা সবাই জানি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এগুলো ভয়ঙ্কর। কিন্তু সে নিমিষে সব কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে তা ঐ রাতে প্রথম উপলব্ধি করলাম। ঝড়ের সে রাতে মৃত্যুর রুপ দেখলাম। সে রাতের কথা মনে হলে এখনও গাঁ শিউরে ওঠে, হৃদয়ে বেজে উঠে করুণ সুর। এ রাতের কথা আমি কোনো দিন ভুলব না ।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url