একটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা কর
একটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা কর।
একটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণন :
ছোটো ছোটো বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জলের মতোই অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চিত হয়ে অতল সাগরের মতো অফুরান সম্ভাবনাময় মানবজীবনকে গড়ে তোলে। অনেকটা আমাদের দেশের ছোটো-বড়ো নদ-নদীর মতোই। বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদী সমন্বয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নদীমালা এর গর্ব। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ছড়া, আঁকাবাঁকা মৌসুমি খাড়ি, কদমপূর্ণ খালবিল, যথার্থ দৃষ্টিনন্দন নদ-নদী ও এদের উপনদী এবং শাখানদী সমন্বয়ে আমাদের দেশের বিশাল নদীব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় আজ আমাদের নদীগুলোর গভীরতা কমে গেছে এবং দেশের অনেক অঞ্চল নিচু হওয়ায় বন্যা যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা থেকে একটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি। বন্যাকবলিত এলাকাটি ছিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার লক্ষ্মীপুর গ্রাম। বন্যায় দুর্ভোগে পড়া মানুষের জন্য ‘ত্রাণ বিতরণ কমিটি'র সদস্য হওয়ার সুবাদে যেতে হয়েছিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে। গ্রামটিতে প্রতিবছরই বন্যার ছোবল পড়ে। কিন্তু এবারের বন্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। খরস্রোতা গোমতি নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এবং অবিরাম জলবর্ষণে সম্পূর্ণ গ্রাম এখন পানির নিচে। জনজীবন সম্পূর্ণ বিপন্ন। গ্রামের বাড়িগুলো সাধারণত কাঁচা, তাই বেশিরভাগ বাড়ি বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে। যে দু-একটা উঁচু পাকা বাড়ি আছে, সেখানেও পানি ঢোকার উপক্রম, দরিদ্র মানুষগুলোর অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে স্কুল-ঘরের দোতলা ভবনে, কেউ আবার উঁচু কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে প্রাণ বাঁচাতে। এখানে সেখানে যাওয়া তাদের জন্যে মুশকিল। নৌকারো ঘাটতি ছিল। আমরা যেসব সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম সেসব যে গ্রামে পৌঁছে দেব, তারও কোনো উপায় প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে এক সময় দূরে দুটো নৌকা দেখে মাঝিকে ডাক দিলে তারা উৎফুল্ল হয়ে আমাদের সেখানে নিয়ে গেল। তাদের মুখে গ্রামটির দরিদ্র জনগণের দুর্ভোগের কথা শুনলাম। পানিবন্দি হয়ে হাজার হাজার মানুষ গ্রামটিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় রোগ দেখা দিয়েছে। যখন নৌকা নিয়ে পৌঁছলাম এক-একটা ক্ষুধার্ত মুখ আমাদের যেন অন্নদাতা মনে করে বসল। তাদের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কতটা কষ্টে কাটছে তাদের জীবন। এ এক কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা। আমরা যে ত্রাণসামগ্রী সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছি তা মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষগুলোর মতোই অসহায় হয়ে পড়লাম। ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠছিল। এক মর্মন্তুদ দৃশ্যের অবতারণা হলো। আমার বুক ফেটে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। দ্রুত সামলে নিলাম নিজেকে। পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে সকল আমরা ত্বরিত সমবেত হয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। প্রথমেই উপজেলা পর্যায়ে এবং জেলা পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রীর জন্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান করলাম। আর্থিক স্বচ্ছল মানুষদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালাম। বিভিন্ন হাসপাতালে খাবার স্যালাইন এবং প্রাথমিক সেবার যেসব ওষুধ পাওয়া গেল সেগুলো সংগ্রহ করতে দশজন দশজন করে কয়েকটি দল গঠন করে নিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ী হয়েছিলাম। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা কয়েক হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে পেরেছিলাম। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্যে। মনোবল সদিচ্ছা যা-ই বলি-না কেন মানুষ মানুষের জন্য—এই মানবতাবোধই আমাদের সকল শক্তির প্রেরণা। এ-অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলবার নয়।