ভাব-সম্প্রসারণ : স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে
‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’
অথবা, যা রাখি আমার তরে মিছে তারে রাখি,/ আমিও রব না যবে সেও হবে ফাঁকি,
যা রাখি সবার তরে সেই শুধু রবে/মোর সঙ্গে ডোবে না সে, রাখে তারে সবে।
ভাব-সম্প্রসারণ : সীমাবদ্ধ জীবনের অবসান ঘটিয়ে মানুষকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। পেছনে পড়ে থাকে তার কর্মফসল। পার্থিব জীবনে যারা সৎ কর্ম করে, দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করে, মরে যাওয়ার পরও মানুষ তাদের ভোলে না। মহৎকর্মের জন্যেই তারা মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকে। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলেই জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। এমন ব্যক্তিই মানবসমাজে ধন্য বলে বিবেচিত।
আত্মসর্বস্ব মানুষ স্বার্থচিন্তায় মগ্ন থাকে। নিজ স্বার্থে নিয়োজিত হলে জীবনের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভোগ-সুখের অন্ধ মোহে পার্থিব ভোগ্যবস্তু সংগ্রহে ও সঞ্চয়ে সে প্রবৃত্ত হয়। যত পায়, আরো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যায় বেড়ে। ব্যক্তিমানুষটাকে ঘিরে এভাবে জমতে থাকে সংগৃহীত বস্তুর পাহাড়। অনেকে ভাবে ভোগ্যবস্তু জীবনকে সুখ-শান্তি, আরাম-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে সুন্দর ও মধুময় করে। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আপাতভাবে কিছুটা আরাম ও সুখ এলেও বস্তুসর্বস্ব জীবনে সুখ কখনোই আসে না। বস্তুভার হৃদয়ের স্বাভাবিক বিকাশের পথ দেয় রুদ্ধ করে। মানবজীবন শুধু ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সার্বজনীন স্বার্থ। ব্যক্তিস্বার্থের দিকটি ক্ষুদ্র, সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ বলে, তা কখনো দেশ ও দশের উপকারে আসে না। তাই ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে মানুষ যা করে তা নিরর্থক, নিষ্ফল। মহাকালের চিরন্তন স্রোতে তা বিলীন হয়ে যায়। মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে মৃত্যুর পরও তার সৃষ্ট সোনার ফসল টিকে থাকে। তাই সবার স্বার্থে আত্মনিয়োগ করতে পারলে জীবন হয় সার্থক ও সফল। যাঁরা সত্যিকারের মানুষ তাঁরা নিজের স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে না। যেসব আবিষ্কার ও মহৎ কর্ম আজ বিশ্বকে সভ্যতার চরম শিখরে উপনীত করেছে তার মূলে রয়েছে মানুষের অবদান। কিন্তু তা ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করে রাখা হয়নি, বরং মানুষের জন্যে, দেশ ও দশের জন্যে তা উৎসর্গ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মহৎ কর্মের জন্যে সে অমরতা লাভ করে মানুষের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
মানুষের সব সৃষ্টিকর্ম বৃহৎ জগতের কাছে নিয়োজিত করতে পারলেই সেগুলো সার্থক হয়। মানুষের জীবনও সফলতায় ভরে ওঠে। তাই ব্যক্তিস্বার্থের কথা না ভেবে সবার স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।