বাংলা রচনা : নদীর তীরে সূর্যাস্ত
নদীর তীরে সূর্যাস্ত
[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, রোমান্টিক চেতনা, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্য, সূর্যাস্তের সময় নদীর দৃশ্য, মানব মনে এর প্রভাব, উপসংহার। ]
ভূমিকা : এ পৃথিবীর স্থানে স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের কত বিচিত্র বাহার। ফলে-ফুলে কাননে, আকাশে বাতাসে যে দিকে দু’চোখ যায় শুধু অনন্ত সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি। আর এ সৌন্দর্যরাশির মধ্যে অনিন্দ্য মাধুরিমায় ভরপুর হচ্ছে নদীর সূর্যাস্ত। দিনের অবসানে সন্ধ্যার সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যায় পশ্চিম আকাশে। লুপ্ত হয়ে আসে দিনের আলো, অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পশ্চিম আকাশে তখন ছড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যা সবিতার রক্তরাগ। জগৎ জুড়ে সাজের মোহন মায়াঞ্জন। প্রকৃতপক্ষে সূর্যাস্ত মানুষের মনে চিরকালই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে আসছে। তাই কবি বলেছেন —
একটি দিনের অবসানে মানব জীবনের এমন সব কল্পনা, করুণা ও বিরহ বেদনাপূর্ণ হলেও প্রকৃতপক্ষে সূর্যাস্তের বিচিত্র শোভা মানুষকে কিন্তু কম আকর্ষণ করে না। নদীর তীরে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য আরও মনোরম ও চিত্তহারী।
রোমান্টিক চেতনা : সকল মানুষই কমবেশি রোমান্টিক। তার সেই রোমান্টিকতা যথাযথ স্থান পেলে আরও বেশি করে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ভাবে উদয়ের জন্য যথাযথ পরিবেশ ও সময় প্রয়োজন। নদীর তীরে সূর্যাস্ত রোমান্টিক মনে তেমনি ভাবের সৃষ্টি করে। এমনিতেই নদীর তীরে পড়ন্ত বিকেলে ঘুরতে ভালো লাগে। ঘুরতে ঘুরতে যখন সূর্য অস্তাচলের দিকে যেতে থাকে তার সৌন্দর্যই আলাদা সূর্য যখন অস্তাচলের দিকে যায় তখন তা দেখতে একটি রক্তিম প্লেটের মতো মনে হয়। ভালো করে তাকালে মনে হয় সোনা রঙের প্লেটটি যেন ঘুরছে। আসলে তা নয়। কারণ সূর্য স্থির। ধীরে ধীরে সূর্য দূরে নদীর জলে নেমে যায়। মনে হয় ঠিক নদীর পানিতে যেন তলিয়ে যাচ্ছে সূর্য। এমন দৃশ্য দেখে সকলের মনেই পরম আনন্দের সঞ্চার হয়। কবিরা যেন এমন পরিসন্তুতি কত কবিতাই লিখেছেন তার হিসেব নেই।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্য : নদী-মেঘলা আমাদের এ বাংলাদেশ। অসংখ্য নদী-নালা সারা দেশটাকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। নদী এদেশের শোভা সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর তীরের শোভা সবসময় এক রকম নয়। বর্ষাকালে নদীর তীর জলে ডুবে যায়। তখন সেখানে দাঁড়িয়ে শোভা দেখার চেয়ে নদীর ভয়ঙ্কর মূর্তিই চোখে পড়ে। বর্ষা চলে গেলে নদী তীর পরিচ্ছন্ন রূপ মাধুরী ধরে রাখে। নদী তীরের গাছ, নদীর বুকের নিস্তরঙ্গ শান্ত স্বচ্ছ জলরাশি, দূরের নীল আকাশের উড়ন্ত পাখির অবাধ উড্ডয়ন সবই নয়ন মনে তৃপ্তি এনে দেয়। আমাদের দেশে বড় নদী যেমন আছে তেমনি আছে ছোট ছোট নদী। এ নদীগুলো বর্ষা চলে গেলে শীর্ণ হয়ে যায়। অনেক নদী শুকিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এমনি নদীর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন —
বড় নদীগুলোর প্রবাহ কমে গেলে তার বিশাল বুক অনন্ত বিস্তারী। যোজন যোজন দূরে ওপারের গাছপালা শ্যামল রেখায় সীমায়িত। নদীর বুকে ছোট ছোট বালুচর। কোথাও কোন চরে ফসলের আগমনী। কিন্তু বৃক্ষ শোভা নেই, জনপথ নেই। বর্ষায় জলের নিচে ডুবে যায়। তেমনি কোন বড় নদীর তীরে হেমন্তে কি বসন্তে সূর্যাস্তের শোভা অপূর্ব বলে মনে হয়। সূর্যাস্তের সময় নদীর দৃশ্য : সূর্য উত্তপ্ত অগ্নিপিও। দিনের বেলায় তার দিকে তাকানো কষ্টকর। ভোরবেলা আঁধারের বুকে তীর হেনে আলোর গানে মুখর হয়ে সূর্য আসে জয় পতাকা উড়িয়ে। সারাদিন আলো ও তাপ দিয়ে বিকেল হতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে সূর্য। তাপ কমতে থাকে। তারপর এক সময় সূর্য অস্ত যায় পশ্চিম গগনে। সূর্যের অস্ত রশ্মিপাতে সারা প্রকৃতি সোনালি বর্ণ ধারণ করে। গাছ পালার আড়ালে সূর্য পাটে নামে। তার রূপের সাথে আমাদের সম্যক পরিচয় হয় না। কিন্তু কোন বড় নদীর তীরে দাঁড়ালে ওপারে শ্যামল বন রেখা মাটির সাথে মিশে থাকতে দেখা যায়। দেখা যায় উন্মুক্ত বিশাল নদী বক্ষ, বিচিত্র তার রূপ। ঢেউ আর ঢেউ—উত্তাল তরঙ্গ এগিয়ে যাচ্ছে, উপচাচ্ছে আবার এগোচ্ছে। এ বিপুল জরলাশির গভীর অতলান্ত দেখে হতবাক হতে হয়। আর নদীর উপর সূর্য ভাসে, সারাদিন পরিশ্রমে ক্লান্ত সূর্য যেন একটু আরাম নেবার জন্য নদীর বিশাল বুকে তার স্থান নেবার চেষ্টা করছে। রক্তরাগে ঝলসিত তাই নদীর নীল পানি। ঢেউ খেলছে, নাচছে আর তার মধ্যে সূর্যের শেষ আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে তখনই সূর্যের রক্তিম আভা নদীর বুকে হিল্লোলিত হয়। ক্লান্ত দিবাকরের শেষ রশ্মিও নদীর অসংখ্য ঢেউয়ের বুকে শিহরণ জাগায়। মাঝি পাল তুলে আপন গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে নৌকা ছাড়ে। পাখিরা আপন নীড়ে ফেরে। তাদের কণ্ঠে কিচির মিচির গান মিশে যায় নদীর কলতানের সঙ্গে। নদীর মৃদু কলতান শুধু হৃদয়ের স্বপ্নের মতো জেগে থাকে। সূর্যটা যখন ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে নীলের কোলে মাথা রেখে আরক্ত শরীরে দিগন্ত রেখায় দেহ রাখে তখনই তার প্রতিবিশ্ব নদীর জলে সোনালি সোহাগে খেলা করতে থাকে। নদীর জল চিক চিক করে। তীরে তীরে নিস্তব্ধতা নামে। গাছের মাথায় আলোর নাচন, আকাশে আলোর ফুলঝুরি। শেষবারের মতো প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য অস্ত পারের খেয়ায় উঠে বসে। শান্ত সন্ধ্যা স্তব্ধ কোলাহল নদী তীরে বাধা ছোট ছোট নৌকাগুলো সূর্যাস্তের লাল আভায় ঝলমল করে। বধূরা আসে রাঙা বিকেলের শেষ রশ্মি পায়ে দিনের শেষে জল ভরতে নদীর ঘাটে। শোভাময়ী ধরণীর সোনালি সন্ধ্যায় দ্রুত পা ফেলে বাংলার বধূরা জল নিয়ে ঘরে যায়। দিগন্ত জুড়ে লালিমা সব আকাশের গায়ে আবির রঙ মেখে দেয়। কোথাও শুভ্র মেঘ খণ্ডের সোনালি আভা খেলা করে। তাই নদীর তীরে সূর্যাস্তের কালে কবি গুরুর এক বিচিত্র অনুভূতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।