বাংলা রচনা : ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে স্বরূপ, অতীত দিনের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ছাত্র-শিক্ষকের বর্তমান সম্পর্ক, বর্ণনা, উপসংহার । ]

ভূমিকা : জীবনকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা, দেশের তথা বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা লাভ এবং সে সঙ্গে নিজেদের পরিবেশকে জয় করার জন্য শক্তি অর্জন করার নামই শিক্ষা। এ শিক্ষা অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে গ্রহণ করতে হয়। ছাত্র শেখে—শিক্ষক শেখান। এভাবে জ্ঞান গ্রহণ ও প্রদানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা সুগভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্ক বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শিক্ষক গুরুজন, তিনি পিতৃতুল্য— তবু সে সম্পর্ক ঠিক পিতার মতো নয়; সেখানে পিতার অধিকার ও কঠোরতা নেই, আছে স্নেহসিক্ত এক শাসন। যা ছাত্রের কল্যাণ চায়, উন্নতি কামনা করে। ছাত্র—শিক্ষকের সান্নিধ্যে বসে জ্ঞান অর্জনে তৎপর হয়; সে লাভ করে এক প্রত্যয়— যা তার শুধু বর্তমানকে নয়, ভবিষ্যৎ জীবনকেও প্রভাবিত করে। অনেক ছাত্রকে দেখা যায় শিক্ষকের মুদ্রাদোষটি পর্যন্ত অনুসরণ করে ফেলেছে। এখানে শিক্ষক শুধু শিক্ষক নন, তিনি ছাত্রের কাছে দার্শনিকরূপেই প্রতিভাত হন। শিক্ষক ছাত্রকে কেবল জ্ঞানই দেন না, জ্ঞানের সঙ্গে নিজেকেও দেন।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বরূপ : ছাত্র ও শিক্ষকের মাঝে একটি মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। শিক্ষক শিক্ষাদান করেন এবং ছাত্র জ্ঞান গ্রহণ করে। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যদি দূরত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে তবে শিক্ষক যেমন যথার্থ জ্ঞান দান করতে পারবেন না। তেমনি ছাত্রও জ্ঞানার্জন করতে পারবে না। তাই ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুসুলভ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়। শিক্ষক থাকেন তার কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষক জ্ঞানাহরণের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এবং তা ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দেন। শিক্ষক জ্ঞানের ভাণ্ডার। ছাত্র তার জ্ঞান পিপাসা নিবারণের জন্য শিক্ষকের কাছে নতুন নতুন বিষয় জানতে চাইবে। শিক্ষক আগ্রহ সহকারে সে সকল বিষয় ছাত্রকে জানাবেন। ছাত্রদের আগ্রহ ও শিক্ষকের আন্তরিকতা মিলে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাতে আর কোন মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয় না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে অর্থের বিচারে বিবেচনা করা যায় না। কারণ শিক্ষা দানের যে প্রকৃতি তাতে অর্থের বিষয়টি নিতান্তই গৌণ হয়ে যায়। বরং আর্থিক বিষয়টি বাদ দিয়েই ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে এক পবিত্র সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

অতীত দিনের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক : মানবেতিহাসে জ্ঞানচর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যেদিন জ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হয়েছিল সেদিন থেকেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সূত্রপা-হয়েছিল। অতীতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল পিতাপুত্রের সম্পর্কের সাথে তুল্য। পিতা যেমন তার পুত্রের মঙ্গল কামনা করেন শিক্ষকও তার ছাত্রের মঙ্গল কামনা করেন। বরং পিতা শুধুমাত্র সন্তানকে জন্ম দিয়েই দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। কিন্তু একজন শিক্ষকই ছাত্রকে যোগ্যতর মানুষ হিসেবে তৈরি করেন। প্রাচীনকালে ছাত্র-শিক্ষকের বাসগৃহ অবস্থান করে শিক্ষা লাভ করতো এবং শিক্ষকের সকল কাজে সহযোগিতা করতো। ছাত্র-শিক্ষকের সেবায় নিয়োজিত থেকে বিদ্যার্জন করতো। এভাবে শিক্ষকের একান্ত আপনজন রূপে যথার্থ শিক্ষা গ্রহণ করে ছাত্র একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠত।

ছাত্র-শিক্ষকের বর্তমান সম্পর্ক : অতীতে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল বর্তমান সময়ে আর তা লক্ষ করা যায় না। বিশেষ করে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মন-মেজাজ মনন ও রুচির পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাচীন কাল থেকে বর্তমানকালে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন আর শিক্ষকের বাসায় অবস্থান করে ছাত্রকে বিদ্যার্জন করতে হয় না। বরং ছাত্ররা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিদ্যার্জন করে। শিক্ষকও তার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিমাসে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নিয়ে থাকেন। অর্থের ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ হয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাঝে অতীত থেকে বর্তমানে একটি বড় ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা বর্তমানে একটি বাণিজ্যিক পণ্যের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। নামিদামি শিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জন করতে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। অপরদিকে যে সকল ছাত্রদের আর্থিক সঙ্গতিকম সে সকল ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্কও ভাল নয়। এমনটি ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ছাত্রকে শিক্ষকরা চেনেই না। ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে বর্তমানে একটি বড় ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এর উল্টো চিত্রও লক্ষণীয়। ছাত্ররাও আজকাল শিক্ষকদের বড় একটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। কোন মতে দায় সারাভাবে শিক্ষককে এড়িয়ে যেতে পারলেই তারা যেন বেঁচে যায়। কখনো কখনো পরীক্ষায় ছাত্রদের অন্যায় আবদার রাখতে না পারলে ছাত্রদের কাছে শিক্ষককে লাঞ্ছিত হতে হয়। তাই বলতে গেলে বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলা যায়।

বর্ণনা : আবার ছাত্র পিতার কাছে, অভিভাবকের কাছে যতটা সহজ হতে পারে না, শিক্ষকের কাছে সহজ হয়ে যায় তার চেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান পর্যন্ত চেয়ে বসে। তখন শিক্ষক হন একজন পরামর্শদাতা, পরিচালক ও বন্ধু। বস্তুত একজন শিক্ষক তাঁর নিষ্ঠাবান ছাত্রের কাছে একই সঙ্গে— Friend, philosopher and guide.

একজন ছাত্রও আবার শিক্ষকের কাছে অনেক কিছু। কৃতি ছাত্রের কৃতিত্ব শিক্ষকের অন্তরে যে বিমল আনন্দ দেয় তার তুলনা নেই। আবার ছাত্রের ব্যর্থতায় ও অধঃপতনে শিক্ষক মর্মাহত হন। ছাত্রের কাছে শিক্ষকের কোন প্রত্যক্ষ প্রাপ্তি নেই, তাই ছাত্রের কল্যাণ কামনা একেবারেই স্বার্থহীন। এ সম্পর্ক তাই পৰিত্ৰ, নির্মল। শিক্ষককে ছাত্র অনেক কিছু দিতে পারে। বলা বাহুল্য, তা কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা নয়। দিতে পারে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সার্থকতার বোধ, সফলতার গৌরব। ছাত্ররা আসে নদীর স্রোতের মতো, সে স্রোত শিক্ষককে আরো বেশি জীবন্ত করে তোলে।

নানা কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার বিপর্যয়ে ছাত্র-শিক্ষকের এ সম্পর্কে চিড় ধরে। এ পরিস্থিতি অবশ্যই বেদনাদায়ক। ত্রুটিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার জন্য ছাত্র যখন দেখে যে, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন, বেকারত্বের অভিশাপ তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে, তখন সে বেপরোয়া হয়ে পড়ে, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে, কেউ ভাসতে থাকে কচুরিপানার মতো, কেউবা জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধের সাথে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তখন চাপা পড়ে যায়— শিক্ষকের কদর যায় কমে । আবার দারিদ্র্য পীড়িত শিক্ষকের হতশ্রী, দৈন্যদশা বিত্তবান অভিভাবকের সন্তানদের মনে শ্রদ্ধার পরিবর্তে করুণা মিশ্রিত অবজ্ঞা সৃষ্টি করে। শিক্ষকেরও অধঃপতন ঘটতে পারে বৈকি। যে নীতিনিষ্ঠা তাঁকে অভ্রভেদী হিমাচলের মর্যাদায় সমাসীন রাখে, দারিদ্র্যকে সহ্য করার শক্তি যোগায়, সেখান থেকে বিচ্যুত হলে শিক্ষক ছাত্রের কাছে শ্ৰদ্ধা পান না। এজন্য শুধু ছাত্র বা শিক্ষককে দায়ী করা ঠিক হবে না। শিক্ষকতা তো শুধু চাকরি নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে সেবা। কিন্তু সেবকের জীবনটি যদি অনাহারে, অর্ধাহারে বিপর্যস্ত থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে মহৎ কিছু আশা করা যায় না— আশা করলেও তা পাওয়া যাবে না। শিক্ষকও সমাজেরই একজন মানুষ। তারও স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ সংসার আছে, সংসারের প্রয়োজন তাঁর সামনে হাঁ করে এসে হাজির হয়। তাঁর ভেতরে যদি আগুন না জ্বলে, অভাবের আগুন যদি গ্রাস করে নেয় জ্ঞান ও উদ্দীপনার অগ্নিশিখাকে, তবে ছাত্রকে তিনি উদ্দীপ্ত করবেন কিভাবে?

পরিকল্পিত শিক্ষা-ব্যবস্থা দ্বারা ছাত্রকে এভাবে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তাঁর জ্ঞান দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে অপরিহার্য। শিক্ষা তাঁর জীবিকার যেমন নিশ্চয়তা দেবে, তেমনি তা দেশের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। শিক্ষিত লোকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে সর্বতোভাবে। এর ব্যতিক্রমেই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের অবনতিও সে ব্যাধিরই পরিণতি ।
কি বাংলাদেশে আজ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে অবক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। ছাত্ররা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত, তাই শিক্ষকের আদর্শ তাকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। অন্যদিকে যা আগেই বলেছি, কোন কোন শিক্ষকও হারাচ্ছেন আদর্শবোধ। শিক্ষক ছাত্রের গর্ব; ছাত্র শিক্ষকের অহঙ্কার। যেমন প্লেটো ও তাঁর ছাত্র অ্যারিস্টটল গর্ব ও অহঙ্কার ছিলেন পরস্পরের।

বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে কিছুটা ম্লান করেছে। এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষকের দায়িত্বকে সঙ্কুচিত করেছে। শিক্ষক এখন স্কুলে পড়ানো ছাড়াও ছাত্রের বাসায় গিয়ে পাঠদান করে থাকেন। বাড়তি আয়ের জন্য শিক্ষকেরা তাঁদের আদর্শ হারাচ্ছেন। আমাদের দেশে বিশেষত শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার, এখানে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধে পাচ্ছে। তবে, তাদের জ্ঞানের পরিধি কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষকেরা পরীক্ষার হলে তাঁদের বিশেষ ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছে অথবা অন্য কোন সুবিধে দিচ্ছে। এগুলো সবই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে করছে কলুষিত। এসব খারাপ দিকের কারণে ছাত্ররাও তাদের শিক্ষকদের প্রতি যথার্থ সম্মান হারাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব অনিয়ম ভেঙে না ফেললে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হবে হুমকির সম্মুখীন এতে কোন সন্দেহ নেই। 

উপসংহার : আজকে আমরা সে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে চাই। শিক্ষক যেন বন্ধু, দার্শনিক ও পরিচালক হতে পারেন ছাত্রের জীবনে; আবার ছাত্রও যেন গর্বের পাত্র হয় শিক্ষকের জন্য। রাষ্ট্রনেতা, সমাজসেবক, শিক্ষক ও ছাত্র— সবাইকে এ কথাটা ভাবতে হবে। মনে রাখা চাই যে, দুর্গতির জন্য ব্যক্তি মানুষ যত না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী পরিবেশ। পরিবেশের উন্নতির উপরই ব্যক্তির চরিত্র অনেকাংশে নির্ভরশীল। সে পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাধুর্য শুধু অটুটই থাকবে না, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url