বাংলা রচনা : নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, নিরক্ষরতা ও আমাদের সমাজ, ছাত্র জীবনের পরিধি, ছাত্রজীবনের কর্তব্য, ছাত্রজীবনের দায়িত্ব, ছাত্র সমাজ ও রাজনীতি, উপসংহার। ]

ভূমিকা : এক অর্থে একটি মানুষের গোটা জীবনই ছাত্র জীবন কারণ সারাজীবনই মানুষকে শিখতে হয় বা জ্ঞানার্জন করতে হয়। কিন্তু সাধারণত ছাত্র জীবন বলতে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো পাঠ্য জীবনকেই বোঝানো হয়। অক্ষর জ্ঞান থেকে এর শুরু শিক্ষা শেষে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত এর স্থিতিকাল। প্রকৃত অর্থে জীবনকে গড়ে " তোলার ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ভূমিকা হিসেবে ছাত্র-জীবনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বীজবপনের এটিই হলো শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে ছাত্ররা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে অবহেলায় নষ্ট করছে। কেন তারা এটি করছে তার পিছনে ছোট বড় অনেক কারণ সক্রিয়। তবে বড় কারণ হচ্ছে দেশের দূষিত রাজনৈতিক পরিবেশ। তারপরেও আজকের ছাত্ররা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এরাই সমাজের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজে এগিয়ে আসতে পারে।

নিরক্ষরতা ও আমাদের সমাজ : নিরক্ষরতা সমাজ-জীবনের অভিশাপস্বরূপ। সাধারণত যাদের স্বাক্ষর জ্ঞান নেই তাদেরই নিরক্ষর বলা হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত। বিশেষত শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে না পারার কারণে মানুষ শিক্ষা লাভে আগ্রহী হয় না। ফলে তারা অশিক্ষিত বা নিরক্ষর থেকে যায়। শিক্ষা লাভ না করলে সে মানুষকে দিয়ে কোন কল্যাণকর কাজ আশা করা যায় না। যে দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি সে দেশ তত উন্নত। আমাদের দেশে অশিক্ষিত মানুষের সংখ্য বেশি ফলে দেশ পশ্চাৎপদ রয়ে গেছে। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। ফলে আমাদের সমাজজীবনে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সমাজের প্রতিটি মানুষকে নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। তবে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এজন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কারও একক প্রচেষ্টায় এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধান করা সম্ভব নয়। নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারলেই দেশের ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব।

ছাত্রজীবনের পরিধি : মানুষের জীবনের ৪/৫ বছর হতে ছাত্রজীবন শুরু হয় এবং শেষ হয় ২৫/৩০ বছর বয়সে। এর মধ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত হয়। প্রাচীনকালে বিদ্যার্থীকে গুরুগৃহ থেকে বিদ্যা লাভ করতে হতো এবং গুরুর কাজ কর্মও করে দিতে হতো। বর্তমানে ক্যাডেট কলেজ, এম. ফিল ও পি.এইচ. ডি-এর ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষণ পদ্ধতি কিছুটা প্রাচীনকালের গুরু গৃহের শিক্ষা পদ্ধতির সাথে সাদৃশ্য আছে।

ছাত্রজীবনের কর্তব্য : লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন করাই ছাত্রদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা যদি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারে তবে তারা কর্মক্ষেত্রে যেখানেই যাবে সেখানে সফলতা লাভ করতে পারবে না। তাই ছাত্রদেরকে তাদের মেধা-মনন ও বিবেক বৃদ্ধিকে জাগ্রত করার জন্য অধ্যয়ন করতে হবে। সংস্কৃতে একটি প্রবাদ আছে “ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ” অর্থাৎ ছাত্রজীবনের তপস্যা হলো অধ্যয়ন করা। ছাত্রজীবনের অন্যান্য প্রধান কর্তব্য হলোー

১. বয়স্ক ব্যক্তি, গুরুজন, শিক্ষক ও পিতামাতাকে সম্মান করতে হবে।
২. চরিত্র গঠনের জন্য সত্যবাদী, সদাচারী, সদাভাষী, বিনয়ী ও নম্র হতে হবে।
৩. অসৎ সঙ্গ, বদভ্যাস, মাদকাসক্তি ও ধূমপানে আসক্ত না হওয়া ।
৪. নিজের শরীর ও স্বাস্থ্য সুস্থ সবল সচল রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত আহার ও খেলাধুলা করতে হবে। 
৫. জ্ঞানাহরণের জন্য পাঠ্য পুস্তক ছাড়াও অন্যান্য বই পড়তে হবে।
৬. ছোট ভাইবোনদেরকে লেখা-পড়ার প্রতি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতে হবে।
৭. নিজের সাধ্যানুযায়ী নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান দিয়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ করতে হবে।
৮. ছাত্রজীবনে সময় নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে।
৯. সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করতে হবে।
১০. উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এসে রাজনৈতিক জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে।
১১. বিকৃত ও অশ্লীল সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে মানবতা বোধে বিশ্বাসী বাঙালি সংস্কৃতি সম্পন্ন হতে হবে।
১২. মিতব্যায়ী ও সদালাপী হতে হবে।
১৩. চাল-চলনে, আচার-আচরণে, আহারে-ব্যবহারে পোশাকে-আশাকে মাত্রা জ্ঞান থাকতে হবে।
১৪. নিয়মিত পাঠভ্যাস করতে হবে।
 
ছাত্রজীবনে এ কাজগুলো করতে না পারলে ভবিষ্যৎ জীবনে তাকে বেগ পেতে হয়। কারণ আজকের যে ছাত্র সেই আগামী দিনের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলা, শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিভাবক যে কেউ একজন হবে। তাই ছাত্রজীবনে নিয়ম মাফিক কাজ না করলে ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নতি করা যায় না।

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব : ছাত্রজীবনেও বিশেষ কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যথা- নিরক্ষতা দূরীকরণে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। কোন ছাত্র যদি প্রতি বছর দুইজন করে নিরক্ষর মানুষকে লেখাপাড়া শেখায় তবে বাংলাদেশের নিরক্ষরতার হার একেবারেই কমে যাবে এবং এক পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় এসে নামবে। এ ছাড়া পড়াশুনার ফাঁকে ছাত্ররা সমাজ উন্নয়নের কাজ করতে পারে যথা- বৃক্ষরোপণ, ছোটখাট রাস্তা, পুল, সাঁকো মেরামত, কচুরিপানা ও আবর্জনা পরিষ্কার। ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে একাজ করে সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। এছাড়া জনগণকে কুসংস্কার ও প্রান্তি ধারণা হতে মুক্ত করে তাদের মধ্যে সামাজিক চেতনা জাগ্রত করতে পারে।

দেশ ও দশকে ভালোবাসা ছাত্রজীবনের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। ছাত্ররাই দেশের সচেতন নাগরিক। দেশের প্রয়োজনে তারাই এগিয়ে আসে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং ১৯৯০ এর আন্দোলনে ছাত্ররাই অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল আগামী দিনেও সচেতন ছাত্ররা দেশের জন্য তাদের মহান কর্তব্য পালন করবে। তবে ছাত্রজীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা যেন না আসে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি : বর্তমানের ছাত্রসমাজ রাজনীতি সচেতন হওয়া ভালো কিন্তু ছাত্রসমাজ যেন রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে, সন্ত্রাসী না হয়ে ওঠে সেটা আমাদের সকলের কাম্য। বর্তমান সময়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- রাজনীতির দিকে তাকালে দুঃখ লাগে, কারণ তারা এক এক দলের এজেন্ট রূপে কাজ করে। কোন নির্দেশের জন্য তারা এটা তো দলীয় নেতা-নেত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। দলীয় নেতা-নেত্রী যা বলবেন ছাত্র সংগঠনগুলো তাই করবে, তাবেদারী ছাত্ররাজনীতি। এতে মনে হয় ছাত্রদের কোন বুদ্ধি নেই। কোন মেধা নেই। ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষা এবং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কথা না ভেবে নিজ দল ভারী করা, হল দখল করা এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মত্ত থাকে। তারা ব্যবহার করে অত্যাধুনিক অস্ত্র, দলে আমদানি করে এবং লালন করে ক্যাডার, করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মস্তানি, ছিনতাই ও ফ্রি খাওয়া দাওয়া। প্রয়োজন হলে সহপাঠীর বুকে চালায় গুলি। এই কি ছাত্র রাজনীতি; এমন ছাত্র-রাজনীতির আমরা অবসান চাই। এর প্রতিকারে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নিজ নিজ ছাত্র সংগঠন বাতিল করতে হবে। ছাত্ররা রাজনীতি চর্চা করবে, তবে তা সমর নীতির মাধ্যমে নয়। মুক্তবুদ্ধির মাধ্যমে। ছাত্ররা রাজনীতি করবে শিক্ষার জন্য, দেশের সমৃদ্ধির জন্য, কোন দলের ক্ষমতা গ্রহণের হাতিয়ার হিসেবে তারা যেন ব্যবহৃত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা কর্তব্য।

উপসংহার : ছাত্ররাই হলো সমাজ ও দেশের চিরজাগ্রত চিরসবুজ সেনানী। তাদের উপর রয়েছে অসীম দায়িত্ব। আজ দিকে দিকে যখন সাম্প্রদায়িকাতার শ্রেণী বৈষম্যের নির্লজ্জ মত্ততা, যখন অশুভ শক্তির রাহুগ্রাস, যখন মনুষ্যত্ব হরণের পাশব চেষ্টা, তখন ছাত্ররাই দেখাবে নতুন দিনের পথ। কবির ভাষায়—

'আমরা শক্তি, আমরা বল
আমরা ছাত্র দল
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান 
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড় বাদল।'

ছাত্ররাই নতুন যুগের নতুন বাণী বাহক। তারাই দেশে আনে নতুন প্রাণোন্মদনার জোয়ার। সেই জোয়ারে ভেসে যায় পুরানো জীর্ণ যা কিছু সঞ্চয়। তারাই হলো শোষণ মুক্তির সংগ্রাম, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মনুষ্যত্ব না হারাবার সংগ্রাম। মোটকথা ছাত্ররাই দেশ গড়ার কারিগর ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url