বাংলা রচনা : মা, ভাষা ও মাতৃভূমি

মা, ভাষা ও মাতৃভূমি

মা, ভাষা ও মাতৃভূমি

রচনা সংকেত : ভূমিকা, মা ও মাতৃভাষা, মা ও মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি, শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে মাতৃভাষা, সাহিত্যে মাতৃভাষা, সাহিত্যে মাতৃভূমি, উপসংহার।

“মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি যারা অনুরাগহীন তারা পশুবিশেষ।”

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 

ভূমিকা : মানবশিশু মায়ের কারণেই সুশীতল ধরাতলের সুন্দর মুখখানি দেখতে পায়। সদ্যপ্রসূত মানবশিশু ও পশুশাবকের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। উভয়ই বিশাল পৃথিবীর দিগন্তবিস্তৃত আকাশের নিচে দুর্বল ও অসহায়। কিন্তু পশুশাবকের বিশেষত্ব হলো এই যে, সে প্রকৃতি থেকে নিজে নিজেই হাঁটতে শেখে, খেতে শেখে, চলাফেরা করতে শেখে— এজন্য তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু মানব-শিশুর জীবনের অস্তিত্ব নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবে মায়ের আদর- যত্নের উপর। পৌষের কনকনে শীতের মধ্যে মা শিশুকে গরম কাপড় জড়িয়ে বুকে আগলে রাখে, ক্ষুধার তাড়নায় শিশু যখন কাঁদতে থাকে মা তখন শিশুকে দুধ খাইয়ে দেয়। এভাবে অবুঝ শিশু সর্বপ্রথম মাকে চিনতে পারে। মা দৃশ্যের আড়াল হলে, সে কান্নাকাটি শুরু করে। শিশু দিনে দিনে বড় হতে থাকে। মা শিশুকে মা ডাকতে শেখায়। এক সময় শিশু মুখে ‘মা’ উচ্চারণ করে। এভাবে শিশু মায়ের কাছ থেকে সর্বপ্রথম ভাষা তথা মাতৃভাষা আয়ত্ত করে। ধীরে ধীরে শিশু হাঁটতে শেখে। সময়ের পরিক্রমায় সে বড় হতে থাকে। পৃথিবীর আলো বাতাস, তাপ সে গ্রহণ করে। চারদিকের বনবনানী, শ্যামল-শ্যামলিমা, পাহাড় পর্বত, ফসলের মাঠ, সবুজের সমারোহ তাকে মুগ্ধ করে। সে তার চারপাশের প্রকৃতিকে মায়ের মতো ভালোবাসতে শেখে। কারণ জন্মের পর সে এ ভূমিকেই সর্বপ্রথম চিনতে পারে। এ জন্য এ ভূমি তার কাছে মাতৃভূমি।

মা ও মাতৃভাষা : মা আমাদের কাজে পূজনীয়, শ্রদ্ধার পাত্র, বিপদের সাথী, দুঃখে আশ্রয়স্থল। মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়ে মানুষ মায়ের কাছেই ভাষা আয়ত্ত করতে শেখে। জন্ম হতে যে ভাষা উচ্চারণ করে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তাই মাতৃভাষা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “মাতৃভাষা মাতৃস্তনের ন্যায়।” জননীর স্তন্য দুগ্ধে মাতৃভাষার ভাব দোহন করে মানুষ মানসিক পুষ্টি লাভ করে। আজন্ম যে ভাষার সাথে তার পরিচয়, যে ভাষার মধ্য দিয়ে শিশু মাতা-পিতা, আত্মীয় ও পরিজনবর্গের হৃদয়বৃত্তির অভিব্যক্তি উপলব্ধি করে, সে ভাষাই তার অস্থিমজ্জার সাথে মিশে থাকে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের জীবনকে, কৃষ্টিকে এবং চিন্তাধারাকে প্রসারিত করতে পারি। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের শতমুখী ভাবধারাকে আমরা পরিস্ফুট করতে পারি, একমাত্র মাতৃভাষার সাহায্যেই। কবি নিধুবাবু তাঁর কবিতায় লিখেন— 

“নানান দেশের নানা ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা
নানা জলাশয়ের নানা নীর
বিনে ধারার জল মিটে কি চাতকীর।

মা ও মাতৃভূমি : “জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী।” কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বর্গের মহিমায় দীপান্বিত করে নিজেরা মহিমান্বিত হয়েছেন, মাতৃভূমিকে করেছেন গৌরবান্বিত। তাঁরা তাঁদের মাতৃভূমির ভাবনা তাদের কথায়, তাঁদের লেখায়, তাঁদের উচ্চারণে বাঙময় করেছেন কখনও কখনও মাতৃভূমিই তাঁদের কাছে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কবি ফররুখ আহমেদ তাই দেশের মাটি ও মাতৃভূমির মমতায় বিগলিত হয়ে লিখেন –

“ সকল দেশের চেয়ে সেরা আমার দেশের মাটি
মায়ের কোল ছেড়ে মাটি মায়ের কোলে হাঁটি। ”

মাতৃস্তন্য পান করে আমরা যেমন বড় হয়ে উঠি, তেমনি মাতৃভূমির বায়ু, তাপ আলোতে আমরা লালিত হই। আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বৃদ্ধকাল অতিবাহিত হয়। তাই বিনীত সন্তানের মতো মাতৃভূমির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরবের অনুভূতি হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ অদৃশ্য বাঁধনে আমরা জড়িয়ে পড়ি। এ মমত্ববোধ থেকে জননী ও মাতৃভূমিকে স্বর্গের মর্যাদায় আমরা ভূষিত করি।

মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি : মাতৃভাষার প্রতি হৃদয়ের গভীর টান থেকে মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধ জেগে ওঠে। যার সপ্রমাণ ঘটে বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণেই সেদিন বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হায়েনাদের রাইফেলের সামনে বুকের তাজা রক্ত দিতে পেরেছিল। সেদিন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফলে গড়ে ওঠে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে গোটা বাঙালি জাতি মাতৃভূমি রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ দেয়, ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা তাদেরকে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিতে ছিনিয়ে অনুপ্রাণিত করে। ফলে ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে বাঙালি জাতি তার মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করে, আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। এভাবে মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভক্তি মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে মাতৃভাষা : মাতৃভাষা মানবজীবনের অমৃত রসায়ন। তাই আজ পৃথিবীর সকল সভ্যদেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কোন দেশ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা শিক্ষা না করা সত্ত্বেও শুধু মাতৃভাষার মাধ্যমে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। শিল্প বাণিজ্য, জ্ঞান-গরিমার উন্নতির মূলেও আছে এ মাতৃভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে এবং সেসব দেশে সর্বক্ষেত্রে উন্নতি প্রদর্শন করে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে আজ পৃথিবীর মনীষীবৃন্দ একমত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার মতে, “বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষায় তোতা পাখির মতো মুখস্থ শক্তি যেমন বাড়ে সে পরিমাণে মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ে না।” যাদের মনে দেশাত্মবোধ আছে, তাঁরা সকলেই মাতৃভাষাকে যথোচিত সম্মান প্রদান করবে এটাই কাম্য ।

সাহিত্যে মাতৃভাষা : কবি-সাহিত্যিকরা হলেন মাতৃভাষার দরদী সন্তান। তাইতো তাঁরা তাঁদের লেখনীর মধ্যে মাতৃভাষার গুণকীর্তন করেছেন। সাহিত্যিক তসদ্দুক আহমেদ মাতৃভাষার স্তুতি গেয়ে বলেনー

“মাতৃভাষার এমনি মহিমা যে কথা বলাটাই আনন্দের বলিয়া মনে হয়। বাংলা যে আমার মাতৃভাষা সে কথাটা আপনাদের সম্মুখে জোর গলায় বলিতে আমার একটু দ্বিধা হয় না। কারণ তাহা না হইলে আমার নিজের মাকেই অস্বীকার করিতে
হয়।”

মাতৃভাষার এক কাঙাল সন্তান হলেন মধুকবি। তিনি তাঁর বহু কবিতার মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি রচনা করেন –

“ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি
এ ভিখারী দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে
পালিলাম আজ্ঞা সুখে, পাইলাম কালে মাতৃভাষারূপ খনি
পূৰ্ণ মণিজালে।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষার গুরুত্ব তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন –“আমাদের মধ্যে যাহা কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা কিছু অমর করিবে সেই সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার, পোষণ করিবার – প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা।”

সাহিত্যে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সুসাহিত্যিক মোঃ ওয়াজেদ আলী বলেন–  “বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এ মাতৃভাষা ও সাহিত্যের যথোচিত সেবা ব্যতীত আমাদের সামাজিক ও জাতীয় উন্নতি একান্তই অসম্ভব।” 

সাহিত্যে মাতৃভূমি : মাতৃভূমির রূপসুধায় মোহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা জানিয়েছেন উচ্চারণ করেছেন –

“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”

আধুনিক প্রজন্মের কবি সৈয়দ আলী আহসান মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা জানাতে গিয়ে বলেছেন –

“আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ অন্ধকারের স্নিগ্ধ তমাল । ”

কবি-সাহিত্যিকদের কাছে তাঁদের মাতৃভূমির ধূলিকণা পরম আদরণীয় জিনিস, খাঁটি সোনার চেয়েও আরো বেশি খাঁটি। এ খাঁটি সোনার গুণাগুণ বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে সুন্দরভাবে ধ্বনিত হয়েছে –

“আমার দেশের মাটি
ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি।”

বস্তুত মাতৃভূমির মাটি কবি-সাহিত্যিকদের কাছে মধুর চেয়েও মধুর অনুভবের, হীরা-মাণিক্যের চেয়ে মূল্যবান। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উচ্চারণে এ সত্য প্রকটিত হয়েছে –
কাশি
“মধুর চেয়ে আছে মধুর
সে আমার দেশের মাটি
আমার দেশের পথের ধুলা
খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি।”

কবি-সাহিত্যিকরা জানেন মাতৃভূমি তাঁদের শেষ ভরসার স্থান। তাঁদের শেষ আশ্রয়। তাই তারা বলেছেন –

“ও আমার দেশের মাটি
তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা।”

বস্তুত এ মিনতি জানিয়ে কবি ক্ষান্ত হননি। মরার পরেও পরজীবনে কবি মাতৃভূমিতে আবার ফিরে আসার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন –

“আবার আসিব ফিরে
ধানসিঁড়িটির তীরে এ বাংলায়।”

উপসংহার : মাতৃভূমি একটি প্রস্ফুটিত ফুল আর তার সুবাস হচ্ছে মাতৃভাষা। তাই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে মানুষ আবদ্ধ হয় বিনি সুতোর মালার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। মর্মের সবগুলো বাঁধন দিয়ে এদের বেঁধে রাখতে চায় অমূল্য মণিমুক্তার মত। তাই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা ভালোবাসার দাবি, জীবনের দাবি, মনুষ্যত্বের দাবি। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই একটি জাতি লালিত-পালিত ও বিকশিত হয়। জাতির ভাব-কল্পনা, আত্মার আকুলতা, ব্যাকুলতা, হৃদয়ের প্রেম-ভালোবাসা মাতৃভাষার মাধ্যমেই রূপায়িত হয়। তাই মাতৃভাষা মায়ের মতো।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url