ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ

ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ।

ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ। — আলোচনা কর।
অথবা, ‘ভাষা ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না, ব্যাকরণই ভাষাকে অনুসরণ করে।'— আলোচনা কর।

ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলার আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ। ‘ব্যাকরণ শব্দের ব্যুৎপত্তি : বি + আ + √কৃ + অন; এর অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, 'যে বিদ্যার দ্বারা কোনও ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি আলোচিত হয়, এবং সেই ভাষার পঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ-রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ (Grammar) বলে।'

‘ব্যাকরণ” হলো ভাষার সংবিধান। ভাষাকে অবলম্বন করেই ব্যাকরণের সৃষ্টি। ভাষার গতি, প্রকৃতি, তার স্বরূপ ব্যাকরণে বিশ্লেষণ করা হয়। ভাষার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাকরণ থেকে ধারণা লাভ করা যায়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ভাষার যেসব রীতি প্রচলিত হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণই ব্যাকরণের বিষয়বস্তু। ভাষা সৃষ্টি হয়েছে আগে, ব্যাকরণ এসেছে ভাষার পথ ধরে। ভাষার ওপর ব্যাকরণ কোনো নিয়ম চাপিয়ে দেয় না। প্রচলিত ভাষার মধ্য থেকে নিয়মকে আবিষ্কার করে তাকে সুশৃঙ্খল করে মাত্র। অর্থাৎ ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভাষার যখন বিশেষ কিছু নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে তখন তা হয়ে উঠেছে ব্যাকরণের বিষয়। ব্যাকরণের নিয়ম-কানুন ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। সেজন্য ব্যাকরণকে ভাষার সংবিধান বলা হয়।

কোনো ভাষা শিখতে বা জানতে গেলে দেখা যায়—সেই ভাষার বর্ণমালা থেকে শুরু করে বাক্যসংযোজন-প্রণালি পর্যন্ত সব কিছুতেই কোনো না কোনো নিয়মনীতি রয়েছে, অথচ অনেক সময় তা আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত ভাষা মুখ থেকে উচ্চারিত কতকগুলো এলোপাথাড়ি ধ্বনির সমষ্টি নয়। বরং মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ধ্বনিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল নিয়ম ও অর্থ থাকে। যেমন- “আমি ‘উচ্চতর স্বনির্ভর বিশুদ্ধ ভাষা-শিক্ষা' বইটি গড়ি”—এই বাক্যটিকে যদি লেখা বা বলা হয় –“বইটি আমি ভাষা শিক্ষা উচ্চতর পড়ি স্বনির্ভর বিশুদ্ধ”— তাহলে বাক্যটির কোনো অর্থ যেমন বোধগম্য হয় না, তেমনি বাক্যটির ভেতর বক্তব্য প্রকাশের কোনো নিয়ম বা শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায় না। কাজেই দেখা যায়—ব্যাকরণ কোনো ভাষার উপাদান—উপকরণ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে এই রীতি-নীতি ও নিয়ম-পদ্ধতি আবিষ্কার করে ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার সন্ধান দেয়। অতএব, “ভাষার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য উদ্ঘাটন ও নিয়ম-শৃঙ্খলার আবিষ্কার করে তার সুবিন্যস্ত ও সুসংহত বর্ণনার নামই ‘ব্যাকরণ’।”

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা স্পষ্ট যে, ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলার আলোচনাই ব্যাকরণ। ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে,—ভাষায় কখন কী হওয়া উচিত তা বলে না বা নির্দেশ করে না বা বিধান প্রণয়ন করে না, বর্ণনা করে মাত্র। ব্যাকরণের সাহায্যে ভাষার সংগোপন অভ্যন্তর-সূত্র উদ্ঘাটন করে ভাষার বিশুদ্ধ রূপ বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। ফলে ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না।

পরিশেষে বলা যায়, ভাষা যেন বহতা নদী। উৎসদ্বার থেকে নদীর বিপুলকায় জলধারা বেরিয়ে সর্পিল গতিতে কত বাঁকে কত মোড় নিয়ে এগিয়ে চলে মোহনার দিকে। অনুরূপভাবে বিবর্তন, রূপান্তর ও ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে ভাষারও অগ্রগতি ঘটে। এক্ষেত্রে ব্যাকরণের ভূমিকা ভাষাকে নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা নয়, বরং পরিবর্তনের ধারায় ভাষাকে সুশৃঙ্খল, গতিশীল ও জীবন্ত করে রাখা। তাই বলা হয়—'ব্যাকরণ ভাষাকে চলতে নির্দেশ দেয় না কিংবা শাসন করে না, বরং ভাষাই ব্যাকরণকে শাসন করে বা চলতে নির্দেশ দেয়, ব্যাকরণ ভাষার বিষয়কে বর্ণনা করে মাত্র' ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url