বাংলা রচনা : মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষার গুরুত্ব
[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, মাতৃভাষা কী, মাতৃভাষার গুরুত্ব, জাতীয় উন্নতি ও মাতৃভাষা, মাতৃভাষা ও জাতীয়তাবোধ, মাতৃভাষা প্রীতি ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, একুশের চেতনা আন্তর্জাতিক মর্যাদা, উপসংহার। ]
ভূমিকা :
বিনা স্বদেশী ভাষা
পুরে কি আশা।”
কবি রামনিধি গুপ্তের এ পঙক্তিগুলো থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মাতৃভাষা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে কোন কিছু অর্জন সম্ভব নয়। মনের কথা প্রকাশ করতে মায়ের ভাষার জুড়ি নেই। এতে কোন জড়তা নেই, নেই কোন প্রতিবন্ধকতা। মাতৃভাষা প্রত্যেকের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে। তাতে ভাব প্রকাশ ও ভাবের আদান-প্রদানে, শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদানে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মাতৃভাষা ব্যতীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যভাষায় সব কিছু বোঝা বা প্রকাশ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই জাতিকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-চিকিৎসায়-অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করতে হলে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম ।
মাতৃভাষা কী : শিশু মুখের বুলি ফোটে যে ভাষায়, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে যে ভাষা মিশে থাকে তাই মাতৃভাষা। অন্য কথায় শিশু যখন মায়ের মুখাশ্রিত ধ্বনি শুনে কিছু বলতে শেখে তাই মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা-প্রাণের ভাষা।
১. উপলব্ধি, ধারণা ও মননের স্বাভাবিক সামর্থ্য গড়ে তোলে প্রথমত ও প্রধানত মাতৃভাষা ।
৩. পরভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক শক্তির যথেষ্ট অপচয় হয়। সে শিক্ষার সাথে জীবনের ঘনিষ্ঠ যোগও থাকে না ।
৪. দেশ-কালের সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে যোগ রয়েছে তার সঙ্গে গভীর মেলবন্ধন রচনা করতে পারে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ।
৫. স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা গড়ে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে ।
৬. দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে পরভাষায় শিক্ষিত করা সম্ভব নয়। বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ ও সামর্থ্য কেবল মুষ্টিমেয় বিত্তশালী ও মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমিত থাকে ।
উল্লেখ্য বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারলেই সবাই জ্ঞাত হবে মাতৃভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ। আজকের জাপান, জার্মানি ও ফ্রান্সের কথাই ধরা যাক— এসব দেশে জ্ঞানার্জন করতে গেলে প্রথমেই সেসব দেশের ভাষা শিখতে হয়। তাহলে সে দেশের ভাষায় কি তারা সমৃদ্ধ নয়। তারা কি সেখানে বিজ্ঞানে পিছিয়ে রয়েছে? মোটেও না। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব অবশ্যই দেয়া উচিত।
জাতীয় উন্নতি ও মাতৃভাষা : মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এ তিনটি পরম শ্রদ্ধার বিষয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে পৃথিবীর কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জাতির সংস্কৃতির একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই কোন জাতির সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়। মাতৃভাষার উপর ভিত্তি করেই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়। যারা মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে পারে না তারা জাতীয় উন্নয়নও করতে পারে না। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেছেন, “পৃথিবীতে যখন যে জাতি গৌরবের পতাকা উড়াইয়াছেন তখনই দেখিতে পাইবেন, সে জাতি আপনার মাতৃভাষাকে পরিপুষ্ট সমলঙ্কৃত পরিপূর্ণ এবং সমুজ্জ্বল ও সুমার্জিত করিয়া তুলিয়াছেন।” বর্তমান বিশ্বে যে সকল দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে তার মূলে রয়েছে মাতৃভাষা প্রীতি, দেশাত্মবোধ ও শ্রম সাধনা। ইংরেজি পরিমণ্ডলে অবস্থান করেও স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড নিজ নিজ ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রেখেছে।
মাতৃভাষা ও জাতীয়তাবোধ : যে জাতি জাতীয়তাবোধ প্রখর সে জাতি উন্নতির শিখরে উঠবেই এবং তা খুবই অল্প সময়ে। একটি দেশে নানা ধর্ম বর্ণের লোক বাস করতে পারে। কিন্তু তারা যদি জাতীয়তাবোধের এক মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারে তবে সে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। কোন জাতি পরাধীন থাকতে পারে, কিন্তু সে জাতির মাঝে যদি প্রখর জাতীয়তাবোধ জাগ্রত থাকে তবে কোন শক্তিই সে জাতিকে পরাধীন রাখতে পারে না। তারা ঠিকই এক সময় স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। তার প্রমাণ বাংলাদেশীরা দিয়েছে। সূদীর্ঘ পরাধীনতার গ্লানিকে মুছে ফেলে জাতীয়তাবোধের প্রেরণা উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছে। জাতীয়তাবোধের জন্ম নেয় ভাষা প্রীতি থেকেই। বাঙালি জাতির ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েও সারা পৃথিবীতে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মাতৃভাষা প্রীতি ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম : “মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি— এই তিনটি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু।” ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই বাণীটি সর্বজন স্বীকৃত। নিজ নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকা প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা বাঙালি আমাদেরও একটি নির্দিষ্ট ভাষা আছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা, নিজেকে তুলে ধরার ভাষা। এ ভাষা আমাদের গর্ব-অহঙ্কার। এ ভাষা নিয়ে গর্ববোধ করার বহুবিদ কারণ রয়েছে। পৃথিবীর বুকে বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা, যে ভাষা প্রতিষ্ঠার একটি সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে, যে ভাষার সাথে মিশে আছে বাঙালির তরতাজা রক্ত। স্বভাবতই এ ভাষার প্রতি প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠেছে সমস্ত বাঙালির।
আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলছি তা আপনা-আপনিই আসেনি। এর জন্য স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা। অথচ মাতৃভাষা হলো প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের এ অধিকারকে কৌশলে হরণ করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসক। এর ইতিহাস-ঘটনাবহুল। দেশ বিভাগের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে নানাভাবে শোষণ করে। প্রথমে তারা ভাষার ওপর আঘাত হানে। তারা উপলব্ধি করেছিল যে, ভাষাকে যদি ধ্বংস করা যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাবে। তারা আমাদের দাসত্বে পরিণত হবে। এই মানসে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে কার্জন হলের এক সমাবেশে ঘোষণা করলেন— "Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan" তার এই খামখেয়ালিপনা ভাষণ ছাত্রসমাজ ও বাঙালিদের কাছে পাগলের প্রলাপের মতো মনে হলো। কারণ পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগের বেশি লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। বাংলা ভাষার প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ বাঙালি এ বক্তব্যের প্রতিবাদস্বরূপ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তখনই এ ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসার ঘটে পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এর পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। ঐ দিন মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের দাবিতে আপামর জনসাধারণ সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেন। পাকিস্তানি শাসক তাদের দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য আশ্রয় নেয় বুলেটের। হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর। মুহূর্তেই কেড়ে নেয় সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক ও নাম অজানা অনেকের তরতাজা প্রাণ। মাতৃভাষাপ্রেমে বীর বাঙালি এতটাই উদ্দীপ্ত ছিল যে, রাজপথ রঞ্জিত করেও তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাধ্য হয় বাঙালির দাবিকে মেনে নিতে অর্থাৎ বাংলাকে বাঙালির মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। সকলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হয়। বাংলা ভাষা ফিরে পায় তার হারানো ঐতিহ্য। তাই বাঙালির কাছে মাতৃভাষার মাহাত্ম্য অনেকগুণ বেশি।
একুশের চেতনা আন্তর্জাতিক মর্যাদা : বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশ ফেব্রুয়ারি এক স্মরণীয় দিন। একুশ আমাদের চেতনা, একুশ আমাদের প্রেরণা, একুশের ত্যাগ অপরিসীম। তবে এ ত্যাগের চরম মূল্যায়নও হচ্ছে। যে একুশ শুধু বাঙালি জাতির গর্ব ছিল, আজ তা সারা বিশ্বের অহংকার ও গর্ব। যে একুশ ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল আজ তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এখন বিশ্বের সকল মানুষের কাছে চেতনাসঞ্চারী দিন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের পেছনে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন, কানাডি প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম। তাঁর তত্ত্বাবধানে গঠিত কানাডাস্থ— 'Mother Language Lovers of World' নামে একটি সংগঠন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানায়। শেষ পর্যন্ত ইউনেস্কো বাঙালির একুশের চেতনাকে দারুণভাবে উপলব্ধি করে। বাঙালির ভাষাকে সম্মান দেখানোর জন্য এবং যারা এ ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ’১৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর ১৫৭তম অধিবেশনে ৩০তম দ্বিবার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। এ স্বীকৃতি ভাষা শহীদের প্রতি এক বিরাট সম্মান এবং সেই সাথে সমস্ত বাঙালির বিরাট প্রাপ্তি। এই সম্মান প্রাপ্তির মূল কারণ হলো একুশের চেতনা ও বাংলার সন্তানদের সাহসী ভূমিকা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। তবেই যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং তাদেরকে স্মরণ করে রাখার জন্য যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের পরিশ্রম সার্থক হবে ।
উপসংহার : দেশের মর্যাদা বাড়াতে হলে এবং দেশকে বিশ্বের বুকে সমাসীন করতে চাইলে দেশে দরকার শিক্ষার ব্যাপক ও বহুমুখী প্রসার। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাই অনন্য। মাতৃভাষায় পূর্ণ জ্ঞান আহরণের পরই কেবল অন্য ভাষার রস আস্বাদন করা যায়। তাই প্রত্যেক জাতির সর্বক্ষেত্রে সমৃদ্ধির জন্য মাতৃভাষার গুরুত্ব সর্বাধিক ।