বাংলা রচনা : মানব সম্পদ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন

মানব সম্পদ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন

মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা-প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
অথবা, মানব সম্পদ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, বর্ণনা, উপসংহার। ]

ভূমিকা : মানুষ সম্পদ। কিন্তু একজন মানুষ সম্পদ হয়ে দুনিয়াতে আসে না। মানুষ তখনই সম্পদে পরিণত হয় যখন সে উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করে। উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষাই উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের জন্য মানুষকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে থাকে। শিক্ষিত মানুষ তার জ্ঞান, দক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে উৎপাদনের মান ও পরিমাণ বাড়িয়ে জাতীয় উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখতে পারে। এভাবেই শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মানব সম্পদে রূপান্তরিত হয়।

শিক্ষা এমন একটা ব্যবস্থা যা কোন ব্যক্তির আচরণ, চিন্তা ও মনোভাবের স্থায়ী পরিবর্তন এনে দেয়। শিক্ষা জীবনকে বা সমাজকে গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলি বা অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহের বিকাশ সাধন করে। ফলে একজন মানুষ সম্পদে পরিণত হয়।

মানব সম্পদ উন্নয়ন বলতে একজন কর্মক্ষম মানুষের জ্ঞান, স্বাস্থ্য, দক্ষতা ও সফলতা বৃদ্ধির সমাহারকে বুঝায় । সমাজবিজ্ঞানী, অর্থ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সকলেই এক মত, উন্নয়নের ক্ষেত্র মানব সম্পদই একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থনীতিবিদ্রা মানব সম্পদকে মানব পুঁজিও বলে থাকেন। দেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে দক্ষ ও যোগ্য মানব সম্পদের অভাবে মান সম্পন্ন দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন সম্ভব নয়। এমনকি উৎপাদন প্রক্রিয়া স্থবিরও হয়ে যেতে পারে। তাই Human factor are playing the leading role in any development effect.

বর্ণনা : এখন প্রশ্ন, কিভাবে মানব সম্পদের উন্নয়ন করা যায়। মানব সম্পদ উন্নয়নকল্পে অনেক কথাই শোনা যায়। তবে এর উপায় নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। তবে বলা যায়, মানবগোষ্ঠীকে মানব সম্পদে রূপান্তরের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া মানুষকে মানব সম্পদ বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে সর্বাগ্রে শিক্ষাকে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শিক্ষা ও দক্ষতা বিস্তারের মাধ্যমে সে দেশ উন্নয়নের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেখানে শ্রমিকের দক্ষতা ৩০% বাড়ে শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকের দক্ষতা বৃত্তি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে জাপান শীর্ষে। মানব সম্পদ উন্নয়নকল্পে আরো উপায় রয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টি জ্ঞান, শিক্ষা ও মানবিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পরিবেশ জ্ঞান প্রভৃতি পদক্ষেপ ও উপায়সমূহ মানব সম্পদ উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। দেশের এ বিপুল সংখ্যক মানুষকে চাহিদামত জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। এদেশে পশু সম্পদের অভাব নেই। এখানকার মাটি সবচাইতে উর্বর। এখানে পাট, চামড়া, চা এসব সম্পদ উৎপন্ন হয়। তাছাড়া মাটির নিচে রয়েছে কয়লা, গ্যাস, চুনাপাথরসহ আরো মূল্যবান বহু প্রাকৃতিক সম্পদ। বিনিয়োগ ও প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানব সম্পদের অভাবে যেমন আমরা বর্তমান সম্পদ সর্বাধিক মাত্রায় ব্যবহার করতে পারছি না তেমনি মাটির নিচের সম্পদকেও আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭৫৫ জন লোক বাস করে। এদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত এবং এদের মাথাপিছু আয় মাত্র ২৬৫ মার্কিন ডলার। শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ তার জাতীয় আয়ের মাত্র ২.২% ব্যয় করে। পাশের দেশ থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ব্যয় করে তাদের জাতীয় আয়ের ৪%। ইউনেস্কো বাংলাদেশকে শিক্ষা খাতে বহু আগেই ৭% ব্যয়ের পরামর্শ দিয়েছিল। কোন কারণবশত তখন তা সম্ভব হয়নি। তবে ইদানীং ব্যয় বরাদ্দ বেশ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। ভূখণ্ডের তুলনায় এ দেশের জনসংখ্যা অধিক। এ বাড়তি জনসংখ্যাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের বোঝার পরিবর্তে মানব সম্পদে পরিণত করা যায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই অশিক্ষিত। প্রকৃত শিক্ষিতের সংখ্যা নিতান্তই সামান্য। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই চলবে না, আমাদের বাস্তবমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা মনে করে দেশের সর্বোচ্চ সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলেই বুঝি পার পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে তারা কারিগরি শিক্ষায় তেমন পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই, সে সব দেশের জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটা অংশ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে। আর বাকি অংশ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের জন্য অবদান রাখে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেরও এ মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। কোন শিক্ষাই ছোট নয়; এ নীতিতে সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে। বাইরের দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকের যথেষ্ট কদর রয়েছে। আমরা যদি বাংলাদেশের বাড়তি জনসংখ্যাকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা অসম্ভব কিছু নয়।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ, বিনামূল্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের পাঠ্যবই সরবরাহ, বিদ্যালয় ভবন সংস্কার ও নির্মাণ, বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সরবরাহ ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো উল্লেখযোগ্য। '৯০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে বাংলাদেশে শিক্ষা সম্প্রসারণের অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং গ্রাম পর্যায়ে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে এবং উপবৃত্তি চালু হয়েছে। তবে আমাদের আরো বেশি সতর্কতামূলক ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু সুপারিশ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির আধুনিকায়ন ও সংস্কার সাধন, স্বাস্থ্য ও শরীর চর্চা শিক্ষা বাধ্যতামূলককরণ, কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ, প্রযুক্তিগত শিক্ষার সম্প্রসারণ, আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে মিল রেখে শিক্ষা সম্প্রসারণ, ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ, চলতি মানব উন্নয়নমূলক প্রকাশনার উদ্যোগ, বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি, মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ; প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধিকরণ। সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুবউন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যকর করা।

উপসংহার : বাংলাদেশ মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে অনেক নিম্নগামী। তাই আগামী বছরগুলোতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাজেট ও পরিকল্পনাকে গণমুখী করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদেরও মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ সম্ভব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url