কলেজে প্রথম দিনের অনুভূতি ব্যক্ত করে একটি দিনলিপি রচনা কর
কলেজে প্রথম দিনের অনুভূতি ব্যক্ত করে একটি দিনলিপি রচনা কর।
কলেজে প্রথম দিনের অনুভূতি ব্যক্ত করে একটি দিনলিপি
রাত ১০টা ১০ মিনিট
জীবন হলো জাগ্ৰত মুহূর্তের কতকগুলো অনুভূতির সমষ্টি। দিন আসে দিন যায়, মাস পেরিয়ে একসময় বছরও কেটে যায়— স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলায় জীবনও থেমে থাকে না। সুখ-দুঃখকে বয়ে নিয়ে সেও ধেয়ে চলে। এরই মধে স্কুলজীবন কাটিয়ে কলেজ জীবনে পদার্পণ করেছি।
আজ ছিল আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিন। জীবনের এক স্মরণীয় দিন গত হচ্ছে আজ। দিনটি জীবনের খাতায় অবিস্মরণীয় করে রাখতেই আমি তা দিনলিপিতে বন্দি করতে চাই।
সকাল থেকেই চঞ্চল মন আমাকে বারে বারে অস্থির করে তুলছিল। কোনোভাবেই মনকে স্থির করতে পারছিলাম না। কিছুটা কৌতূহল, স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে পড়ার অনুভূতি, নতুন অপরিচিত সহপাঠী এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা, কলেজের নতুন পরিবেশ— সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল, ক্রমেই আমার মন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। বারবার মনকে স্থির করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। সেদিন রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে সকালের নাস্তা খেতে মন চাচ্ছিল না। এদিকে মা দ্রুত নাস্তা খেয়ে কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে তাড়া দিচ্ছেন। এবার মা নাস্তা-হাতে হাসিমুখে বললেন, আজ তো তোর কলেজের প্রথম দিন। এ-সুযোগে আমি মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে নিয়েছিলাম। মা আমাকে আশীর্বাদ করলেন। মুহূর্তেই আমার মনের ভয় জড়তা সবই কেটে গিয়েছিল। আনন্দে আমি তখন নিজেকে খুব হালকা অনুভব করছিলাম। ঝটপট কলেজ ড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। তখন ঘড়িতে আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সকাল আটটায় কলেজের উদ্দেশে পা বাড়াতেই অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে উঠল। কিছু সময়ের ব্যবধানেই কলেজে গিয়ে হাজির হলাম। কলেজের বড়ো বড়ো বিল্ডিং আমাকে মোহিত করল। বিল্ডিংগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন বাণী আমার দৃষ্টিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল :
বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/এসো, তবে আজ বিদ্রোহ করি।'
কিছুটা সংকোচ ও জড়তা আবারও আমাকে পেয়ে বসল। হঠাৎ দেখি গতকাল যে বন্ধুটির সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম সেই বন্ধু মিঠু আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। এবার মনের জোর কিছুটা বাড়ল। মিঠু এবং আমি একসঙ্গে শ্রেণিকক্ষে ঢুকলাম। মিঠুই আমাকে অপরাপর বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি খানিকটা বোকার মতো হাসিমুখ রেখে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিলাম। ইতোমধ্যে ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ল।
আমার জীবনে পরম আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে এসেছিল কলেজের প্রথম দিনের, প্রথম ক্লাসটি। প্রথাগত নিয়মে অধ্যক্ষ মহোদয় নিজেই প্রথম ক্লাসটিতে আসেন। তিনি কোনো বিষয় পড়ালেন না, কিন্তু ছাত্রজীবনের কর্তব্য সম্পর্কে এবং এই প্রতিষ্ঠানের আচরণ বিধি সম্পর্কে যে উপদেশ বাণী দিলেন তা জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকবে। তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের উদ্বুদ্ধ করলেন, কীভাবে জীবনকে আলোকিত করতে হবে এবং ছাত্রজীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে বললেন, সচেতন করে তুললেন কলেজ-জীবন সম্পর্কে। এ জীবন যে একবারই আসে এবং তা যে সফল করে তোলার দরকার তা তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করলাম। তারপর রুটিন মাফিক ক্লাস। এরপর ছিল বাংলা ক্লাস। স্যারে এসে ক্লাসে ঢুকলেন। প্রথমেই তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন।র এবং সকল ছাত্রকে উচ্চতর জীবন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে আহ্বান করলেন। কেমন একটা অজানা ভয় এবং একইসঙ্গে আনন্দে বুক কাঁপছিল। ক্লাস নিচ্ছেন অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম। স্যার সবার উদ্দেশে প্রথমে যে কথাটি বললেন, তা হলো—
ছিপছিপে গড়নের মানুষটি এত চমৎকার বাচন ভঙ্গির অধিকারী যে আমি তাঁকে প্রথমেই পছন্দ করে ফেললাম। যথাসময়ে ঘণ্টা পড়ার ধ্বনি, স্যার চলে গেলেন। এরপরই একের পর এক আবিষ্কার। প্রথমেই দেখা গেল, একটি ক্লাসরুমে সব বিষয়ের ক্লাস হয় না। তাই প্রতি ক্লাসের শেষে করিডোর ধরে সবাই ছুটে যাই পরের ক্লাসের সেরা আসনটি দখল করতে। আর টানা তিনটের বেশি ক্লাস করার প্রয়োজন নেই। সেই অবসরে কানে আসে কমনরুমের কোলাহল। নতুন ছাত্রের মনে পুলক জাগায় সেই হল্লা। আমাদের সবাইকে তা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে টানে। ক্লাসগুলো কম উত্তেজনার খোরাক জোগায় না। প্রতিটি ক্লাসই আমার কাছে ছিল উপভোগ্য। কলেজ ছুটি হলে বাড়ি ফিরছিলাম আমি একা একা ফিরছি বাসায়, মনের দিক থেকে আমিও চাচ্ছিলাম কখন একলা হব। কেননা কলেজ-জীবনের প্রথম বন্ধু মিঠুকে নিয়ে। দুজনে পুনরায় কলেজের নানা বিষয় নিয়ে গল্পে মেতে উঠলাম। তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এবার দিলাম। কলেজ জীবনের প্রথম দিনেই আমি বুঝতে পারলাম যে, চলমানতাই কলেজ জীবনের ধর্ম। এ-দিনেই আমি দিনটিকে নিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবতে চাই। এর তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা করছি। মুহূর্তেই এক ভাবনার জগতে ডুব স্বাধীন জীবনের পরিপূর্ণ যাদ লাভ করলাম। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমাকে বলে দিল, আমার আছে অফুরন্ত স্বাধীনতা।
কিন্তু আমাকে সময়ের অপব্যবহার করলে হবে না, বন্ধুত্বও করতে হবে সৎ, ভদ্র ও রুচিশীল ছেলেদের সঙ্গে। আরো কত যে স্মৃতি আজ ভেসে উঠছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বোধ হয় সারাক্ষণই লিখে যেতে পারব। ভাবুক মন নিয়ে বাসায় ফিরলাম। হাসিমুখে সবাইকে বললাম খুব ভালো লেগেছে, খুব ভালোভাবে কেটেছে সময়টা। দারুণ উপভোগ করেছি কলেজের প্রথম দিনটিকে। মনের মধ্যে গেঁথে রইল কলেজ জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতাটি। এই আনন্দঘন অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে— তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।