সর্বজনীন পেনশন
ভূমিকা : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকে ঈর্ষান্বিত সাফল্য দেখিয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও করোনাকালীন অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মতো সক্ষমতাই তার উদাহরণ। ফলে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, অতি শীঘ্রই এশিয়ার মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ নিজস্ব অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেবে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধনীর সংখ্যা কমলেও বাংলাদেশে তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। পুরো দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে চলে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। চলমান উন্নয়নের সুবিধা নিম্ন আয়ের মানুষ পর্যন্ত না পৌঁছালে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে । এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সরকারের আরও একটি পরিকল্পনা হলো সর্বজনীন পেনশন সুবিধা চালু করা ।
সর্বজনীন পেনশন : দেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম ব্যবস্থা চালু করার একটি মহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে নাগরিকগণের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার রয়েছে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে অর্থবিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সব শ্রেণির বয়স্ক নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা অচিরেই শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমানে এই পেনশন স্কিমের আওতায় ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিককে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি চালু হলে ৬০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত একজন নাগরিক এই সুবিধা পাবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু যারা স্বেচ্ছায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় এগিয়ে আসবে শুধু তারাই এই সুবিধার আওতাভুক্ত থাকবেন ।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার স্বরূপ : সরকার নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিককে এই পেনশন স্কিমের আওতায় নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক করার চিন্তা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমানভিত্তিক একটি হিসাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চাঁদা হিসেবে জমা দিয়ে এই পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন । সর্বনিম্ন মাসিক ফি'র পরিমাণ ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে । এই সুবিধা পেতে হলে কমপক্ষে ১০ বছর ধরে মাসিক ফি চালিয়ে নিতে হবে। তবে এই পেনশনে নাম অন্তর্ভুক্ত করানো বাধ্যতামূলক করা হবে না। ৬০ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার পর পেনশন হিসেবে এককালীন অর্থ প্রাপ্তিসহ প্রত্যেক নাগরিক তার নিজের কন্ট্রিবিউশন অনুযায়ী আজীবন মাসিক পেনশন সুবিধা পাবেন । আর সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির পর কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যরা সুবিধা পাবেন। পেনশন তহবিলে নাগরিকদের চাঁদা হিসেবে জমা দেওয়া তহবিল ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারের লাভজনক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হবে। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমবে। দেশজুড়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হওয়ার পর থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তদেরও এই পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে দেশজুড়ে বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর আমৃত্যু তারা আর্থিক সুবিধা পান প্রতি মাসে। সেই চাকরিজীবী মারা গেলে তার স্ত্রী এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে তাকেও আমৃত্যু পেনশন দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি খাতে কর্মকর্তাদের জন্য অবসর জীবনেও তাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুবিধা নেই
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রধান লক্ষ্য : সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো— বৃদ্ধ বয়সে কর্মরত জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মানকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে রাখা; নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করে তাদের একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একীভূত করে সেটিকে বিনিয়োগে রূপান্তর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে মূলধন সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা।
বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির সংখ্যা ৫ কোটি ৮৭ লাখ। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৫ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে নিয়োজিত ১০ শতাংশ। এই ১৫ শতাংশ হলো দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাত, বাকি ৮৫ ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, যাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। তারাও পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত হবে। বর্তমানে দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিশাল একটি অংশ প্রবীণ । তাই তাদের সংখ্যা বাড়ায় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে । এ অবস্থায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷
সর্বজনীন পেনশনের কতিপয় শর্তাবলি :
• ১৮-৫০ বছর বয়সে সকল নাগরিক পেনশন আওতায় থাকবে।
• বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মচারীরা পেনশন ব্যবস্থার আওতায় থাকবে।
• সরকারি কর্মচারীদের বেলায় পরবর্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
• প্রথমে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে পরে বাধ্যতামূলক করা হবে।
• কমপক্ষে ১০ বছর ধারাবাহিকভাবে চাঁদা প্রদান করলে তবেই পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবে ।
• প্রত্যেকের একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে।
• সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।
• মাসিক চাঁদার হার নির্ধারণ করা থাকবে, তবে প্রবাসীরা ৩ মাস অন্তর টাকা জমা দিতে পারবে।
• বিলম্ব ফি সহ টাকা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
• অগ্রিম চাঁদা প্রদান করা যাবে।
• শুধুমাত্র ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হলেই পেনশন হবে।
• মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবে।
• পেনশন গ্রহিতা ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে নমিনি বাকি সময়ের জন্য পেনশন পাবেন।
• পেনশনের টাকা কেউ এককালীন উত্তোলন করতে পারবেন না। তবে ৫০% ঋণ হিসাবে নিতে পারবে এবং সুদসহ ফেরত দিতে হবে।
• ১০ বছর টাকা জমা দেওয়ার পর কেউ মারা গেলে জমানো অর্থ সুদসহ নমিনীকে ফেরত দেওয়া হবে।
• মাসিক পেনশন বাবদ অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
উপসংহার : সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা থেকেই উদ্ভব। তাই স্কিমটি পরিচালনা করাও এমন কোনো কঠিন কাজ নয় বলে আশা করেন বিশ্লেষকরা। এটি কোনো নতুন ধারণা নয় । পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ স্কিম চালু করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস-সহ অনেক উন্নত দেশে এ স্কিম কার্যকর রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ জনবল এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে কল্যাণকর ও সুখী-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ব্যবস্থা নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে এমনটিই প্রত্যাশা ।