বাংলা রচনা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। শিল্প বিপ্লবের পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন পৃথিবীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা । তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন উন্নতির ফলে গোটা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বের সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার। যে জাতি তথ্য প্রযুক্তিতে যত বেশি দক্ষ, তাদের সার্বিক অবস্থাও তত বেশি উন্নত। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশও ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তির অনেক পথ পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে তথ্য প্রযুক্তিকে বাংলাদেশের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ।

তথ্যপ্রযুক্তি : তথ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবস্থাপনা এবং বিতরণের জন্য ব্যবহৃত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির সমন্বয়কে তথ্যপ্রযুক্তি বলা হয় । কম্পিউটিং, মাইক্রো ইলেকট্রনিক্স, টেলিকমিউনিকেশন ইত্যাদি বিষয় তথ্য প্রযুক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তথ্যপ্রযুক্তির (আইটি) মূল চালিকাশক্তি হলো ইন্টারনেট, যা বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ামক। অন্যকথায় বর্তমান বিশ্ব অর্থব্যবস্থাকে ইন্টারনেট অর্থনীতিও বলা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতিশীলতার চেয়ে বহুগুণে বেশি ও ব্যাপক ক্রিয়াকর্মের সমাধান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল অর্থনীতিই জাতীয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার সম্ভব করে তোলে । বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহ ভোক্তা, সরবরাহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে তথ্যসূত্রে গ্রথিত করে । বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে যা বিশেষ ভূমিকা পালন করে ।

তথ্যপ্রযুক্তিতে বর্তমান বাংলাদেশ : গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে ঘটেছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন। বাংলাদেশও তথ্যপ্রযুক্তির এ জীয়নকাঠির স্পর্শে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় ৬০-এর দশকে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহের সাম্রাজ্য ইন্টারনেটের সঙ্গে। ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয় । ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে অনলাইন নেটওয়ার্কের প্রচলন শুরু হয় । বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১২.২৮ কোটি। দেশে এখন কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭ থেকে ৮ হাজারের মতো। সারা দেশে কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের শো-রুম রয়েছে সহস্রাধিক। তাছাড়া বর্তমানে কম্পিউটার মেলা, প্রোগ্রামিং, প্রতিযোগিতা, ওয়েব ডিজাইন প্রতিযোগিতা এবং কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সেমিনার হচ্ছে অহরহ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা : তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে উন্নত দেশগুলোতে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতে তার প্রভাব অনেক আগে পড়লেও আমরা তা থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছি। তথ্যপ্রযুক্তিকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে এবং মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, ভারত, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। অথচ আমাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে আজ আমরা তথ্যের সুপার হাইওয়ের সাথে যুক্ত হতে পারছি না। আবার সরকারের অনীহার কারণে ফাইবার অপটিকস ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। তাই আমাদের প্রচুর টাকা খরচ করে ব্যবহার করতে হচ্ছে ভি স্যাটের লাইন। তবে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে। দেশে কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি বেশ বেড়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার সফটওয়্যার বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

সম্ভাবনাময় সফটওয়্যার শিল্প : বাংলাদেশে বর্তমানে সফটওয়্যার শিল্প সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে দেখা দিয়েছে। হার্ডওয়্যার নির্মাণের সঙ্গে এখনো বাংলাদেশ তেমনভাবে জড়িত হয়নি। এ দেশে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট তিনটি ক্যাটাগরিতে হচ্ছে। এগুলো হলো : কাস্টমাইজড সফটওয়্যার, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার ও ওয়েব সফটওয়্যার। এর মধ্যে দেশে শিক্ষা ও বিনোদনে কম্পিউটারভিত্তিক মাল্টিমিডিয়ার বাজার অতি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। দেশের ১৬ শতাংশ সফটওয়্যার ফার্ম তাদের ডেভেলপ করা সফটওয়্যার বিদেশে রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ভুটান, কানাডা, সাইপ্রাস, দুবাই, জার্মানি, ভারত, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি সফটওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে ।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প : বাংলাদেশে বর্তমানে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৭-৮ হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। বর্তমানে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বেকার যুবদের কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কোনো যুবক-যুবতী আর বেকার থাকছে না। দেশ-বিদেশে এখন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সফটওয়্যার ডেভেলপার ও আইটি কর্মীদের বিপুল চাহিদা দেখা দিয়েছে। তারা সহজেই ভালো উপার্জন করতে পারছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা : বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যে হাওয়া বইছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ধানের নতুন জাত ব্রি এ ৬৭টি এবং বিনা ১৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ডায়াবেটিকবান্ধব ও জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের গবেষণায় বিশ্বে প্রথম সফল হয়েছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। কৃষি বিপণনে মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশ কৃষকবান্ধব হিসেবে কাজ করে চলেছে। সৌরশক্তি, বায়োফুয়েল ও বিদ্যুতের অন্যান্য বিকল্প শক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে; যার মাধ্যমে কৃষকরা বাংলাদেশের গবেষকদের আবিষ্কৃত কৃষিযন্ত্রাদি ব্যবহারে সফলতা পাচ্ছেন। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শস্য উৎপাদনের পদক্ষেপের ফলে মঙ্গাপ্রবণ এলাকায়ও আজ উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে নিচ্ছে উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারমূল্য, দেশ-বিদেশের কৃষির নিত্যনতুন তথ্য। চাষাবাদের ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতির বদলে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের অর্থনীতি হয়ে উঠছে আরো সমৃদ্ধশালী ।

উপসংহার : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিই বর্তমান বিশ্বে সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার। তাই তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও যুবকদের বেকারত্ব দূর করার জন্য আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘রূপকল্প ২০৪১' অর্জন করতে সক্ষম।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url