বাংলা রচনা : রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

ভূমিকা : পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জাতির নাম রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ তার এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে "বিশ্বের সবচেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী' হিসেবে আখ্যায়িত করে। ‘উদ্বাস্তু' ও ‘বন্ধুহীন' এবং বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্রহীন নাগরিক ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গারা।

স্বাধীন আরাকান ও রোহিঙ্গা : স্বাধীন ও সমৃদ্ধ এক জনপদের নাম ছিল আরাকান। বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনাবেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকানকে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করেছে। আরাকানের প্রাচীন নাম ব্রহ্ম জনপদ, বর্তমানে রাখাইন। ইতিহাস বলছে, ১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২,০০০ বর্গমাইল আয়তনের আরাকান (পরবর্তীকালে মিয়ানমার সরকার এ অঞ্চলকে দুটি প্রদেশে ভাগ করে) স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন বার্মা দখল করার পর ১৮২৬ সালে আরাকান ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের অংশে পরিণত হয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলে আরাকান স্থায়ীভাবে দেশটির অংশ হয়। ১৯৮১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে রাখাইন প্রদেশ। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে পূর্ব ভারত থেকে অস্ট্রিক জাতির একটি শাখা কুরুখ নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু (পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত মুসলিম), পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, পাঠান এবং অষ্টম শতাব্দীতে আরবরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এসব নৃগোষ্ঠীর সংকরজাত জনগোষ্ঠীই হলো এ রোহিঙ্গা। নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য ‘রোহান' কিংবা ‘রোহাঙ' নামে পরিচিত ছিল। সেই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবেই ‘রোহিঙ্গা' শব্দের উদ্ভব । বস্তুত রোহিঙ্গারা আরাকান বা রাখাইনের একমাত্র ভূমিপুত্র জাতি । 

রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত : আরাকান রাজ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রোহিঙ্গারা। তারা আরাকানে বহিরাগত নয়, বরং বর্মী রাজারাই আরাকানের দখলদার। মিয়ানমারের সংবিধানে বুনিয়াদি জাতির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাতেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি বুনিয়াদি জাতি । কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ চাপা দিয়ে আর বাস্তবতা উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বহিরাগত । ব্রিটিশরা তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর যে তালিকা প্রস্তুত করে তাতে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেনি। আর এ থেকেই সংকটের সূত্রপাত। উদ্ভূত এ সমস্যার পিছনে একক কোনো কারণ নিহিত নয়, এর পিছনে রয়েছে আরো একাধিক কারণ ও ইতিহাস । নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. আরাকানের পতন : ১০৪৪ সালে স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করে কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাওহতা। তিনি মগদের বার্মা থেকে এনে দক্ষিণাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করেন। এরপর ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য । ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্র সু ধর্মা কর্তৃক মোগল রাজপুত্র শাহসুজাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আরাকানের পতন শুরু হয়। 

২. বার্মার স্বায়ত্তশাসন : ১৯৩৭ সালে বার্মাকে হোম রুল বা স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয় এবং ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের বাদ দিয়ে বর্মীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। ফলে বার্মায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ।

৩. ১৯৪২ সালে রোহিঙ্গা হত্যা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ১৯৪২ সালে, জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে নেয়। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ রাখাইন অধ্যুষিত মিমবিয়া ও ম্রোহাং টাউনশিপে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে রাখাইনরা ।

৪. রোহিঙ্গাদের পাল্টা প্রতিশোধ : রোহিঙ্গা হত্যার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রোহিঙ্গারা উত্তর রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার রাখাইনকে হত্যা করে । সংঘাত তীব্র হলে জাপানিদের সহায়তায় রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করে ফেলে । 

৫. নে উইনের ক্ষমতা দখল : ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক নে উইন মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা গ্রহণ পরবর্তী পর্যায়ে সেনাপ্রধান নে উইন রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন এবং ইতোপূর্বে স্বীকৃত অধিকার ও সুবিধাসমূহ বানচাল করে দেন ।

৬. ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন পাস : ১৫ অক্টোবর ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে । এ আইনে মিয়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্বে বিধান রাখা হয়- পূর্ণাঙ্গ, সহযোগী এবং অভিবাসী। এ নতুন আইনে বলা হয়, ১৮২৩ সালে মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে মিয়ানমারে বাস করা ১৩৫টি গোত্রভুক্ত মানুষই মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। রোহিঙ্গাদের গোত্র হিসেবে অস্বীকার করে সামরিক সরকার। 

৭. নাগরিক কার্ড থেকে বঞ্চিত : ১৯৮৯ সাল থেকে মিয়ানমার তিন ধরনের নাগরিক কার্ডের প্রচলন করে। পূর্ণাঙ্গ নাগরিকদের জন্য গোলাপি, সহযোগী নাগরিকদের জন্য নীল এবং অভিযোজিত নাগরিকদের জন্য সবুজ রঙের কার্ড দেয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের কার্ড দেয়া হয় না। এর ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে। 

৮. নির্দিষ্ট গ্রামে বন্দি : মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। আর তাই 'বহিরাগত' হিসেবে চিহ্নিত এসব রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে কারাগারে । আট লাখ রোহিঙ্গাকে বন্দি করার মতো বড় কারাগার মিয়ানমার তৈরি করতে পারেনি, তাই রোহিঙ্গারা নিজ গ্রামেই বন্দী। যদি ট্র্যাভেল পাসে উল্লিখিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ গ্রামে ফিরতে ব্যর্থ হয় কোনো রোহিঙ্গা, তা হলে তার নাম কাটা যায় এ গ্রামের তালিকাভুক্তি থেকে। সে তখন নিজ গ্রাম নামের কারাগারেও অবৈধ হয়ে পড়ে। তাদের ঠাঁই হয় জান্তা সরকারের জেলখানায় ।

৯. বিয়েতে বাধা : ১৯৯০ সালে আরাকান রাজ্যে স্থানীয় আইন জারি করা হয়। আইনটিতে উত্তর আরাকানে বাস করা মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিয়ের আগে সরকারি অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

১০. জন্মনিয়ন্ত্রণ : ২০০৫ সালে নাসাকা বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এ সময় দীর্ঘদিন বিয়ে সংক্রান্ত আবেদন গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয় নাসাকা । পরের বছর যখন আবার আবেদন গ্রহণ চালু হয়, তখন নিয়মকে করা হয় আরো কঠোর । তখন থেকে আবেদনের সাথে নবদম্পতিকে মুচলেকা দিয়ে বলতে হয় যে এ দম্পতি দুইয়ের অধিক সন্তান নেবে না ।

১১. চিকিৎসা ও শিক্ষায় সীমিত অধিকার : রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার অনেক দূরের ব্যাপার। সরকারি চাকরি তাদের জন্য নিষিদ্ধ । উত্তর আরাকানের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে । 

রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশ : মিয়ানমারে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আসা শুরু করে। সর্বশেষ ২৫ আগস্ট-২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্স'। সর্বশেষ ঢলের মতো আসা শরণার্থীসহ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর বর্তমানে মোট সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক । রোহিঙ্গাদের মূল বাসভূমি রাখাইনের চেয়েও বেশি ।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী : মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ও বর্ণবাদীদের দ্বারা রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হয় ১৭৮৪ সালে। এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৯৪২, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং সাম্প্রতিক সময়ে কোনো একটি কারণ তৈরি করে তারা রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে। মূলত ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছাড়তে শুরু করে। আর গত চার দশকে ১৫-২০ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র।

রোহিঙ্গা গণহত্যা ২০১৭ : ২৫ আগস্ট ২০১৭ সংঘটিত কথিত সন্ত্রাসী হামলার জবাবে উত্তর রাখাইনে ভয়ংকর Scorched Earth বা পোড়ামাটি নীতিতে অভিযান চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে রাখাইনে সেনা ও মগদের হাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয় । রাখাইনের মংডু, বুথিয়াডং ও রাথেদং শহরতলিতে মোট ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ২১৪টি গ্রাম । ঐ তিনটি শহরতলিই ছিল রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের ।

রোহিঙ্গা সংকট ও বিশ্ববিবেক : শুরু থেকেই মিয়ানমার সেনাদের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অভিযানকে ‘গণহত্যা’ (Genocide), আর 'জাতিগত নিধন' বলে অভিহিত করে বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট থেকে বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো । ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া এক বক্তৃতায় The Office of the United পরিশেষে বলা যায়, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সংকট হলো রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতৃত্ব বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও এখন পর্যন্ত রাশিয়া, ভারত ও চীন এ সংকট সমাধানে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চোরাবালিতে পড়েছে।
Nations High Commissioner for Human Rights (OHCHR)-এর সাবেক প্রধান জাইদ রাদ আল হুসেইন বলেছিলেন, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর পরিকল্পিত নির্যাতনের মাধ্যমে জাতিগতভাবে তাদের নির্মূল করা হচ্ছে। 

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত : মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব মিয়ানমারের প্রতি তিনটি আহ্বান জানান। যথা :

১. শরণার্থীদের নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে দেওয়া
২. বাধাহীন ত্রাণ পৌঁছানো ।
৩. অবিলম্বে রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করা ।

নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনার মূল বক্তব্য : 
  • কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে সব সদস্য।
  • শান্তিরক্ষী পাঠানো বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব আসেনি।
  • রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সেখানে যেতে দিতে হবে।
  • সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশ, এ দুই প্রতিবেশী দেশকেই সমঝোতার ভিত্তিতে এক যোগে কাজ করতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) তৎকালীন ২৮টি দেশের পার্লামেন্ট ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (EP) ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মিয়ানমার : বিশেষ করে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি' শীর্ষক আলোচনা শেষে ২০ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করে।

আন্তর্জাতিক গণআদালত ও বিচার : রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে স্থাপিত রোমভিত্তিক Permanent Peoples Tribunal (PPT) নামের এক গণআদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিচারপ্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাত বিশেষজ্ঞের একটি প্যানেল অংশ নেয়। ‘প্রতীকী রায়’ ঘোষণা করেন। রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকারকে অভিযুক্ত করা হয় ।

জাতিসংঘের আদালতে গাম্বিয়ার মামলা : রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগে ১১ নভেম্বর ২০১৯ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ICJ-তে মামলা দায়ের করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া । গাম্বিয়ার দায়েরকৃত ৪৬ পৃষ্ঠার মামলার আবেদনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটন এবং গণহত্যা সংঘটনের ষড়যন্ত্র, নির্দেশনা ও সহায়তাসহ আটটি অভিযোগ করা হয় । ICJ মামলাটি গ্রহণ করে । নেদারল্যান্ডসের হেগে “ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস'- এ মামলা শুনানির আয়োজন করে ১০-১২ ডিসেম্বর ২০১৯। শুনানিতে আন্তর্জতিক আদালতের ১৫ জন বিচারক এবং গাম্বিয়ার পক্ষে একজন ও মিয়ানমারের পক্ষে একজন এডহক বিচারপতিসহ মোট ১৭ জন বিচারক উপস্থিত ছিলেন। এতে গাম্বিয়ার পক্ষে দেশটির আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি তামবাদু এবং মিয়ানমারের পক্ষে ছিলেন অং সান সুচি । গাম্বিয়ার পক্ষের বিচারপতি নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের পক্ষের বিচারপতি প্রফেসর ক্লাউস ক্রেস । তিন দিন শুনানি শেষে এখন মামলাটির রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে উভয় পক্ষ ।

সংকট নিরসনে পদক্ষেপ :

আনান কমিশন ও সুপারিশ : বৈশ্বিক সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ২৪ আগস্ট ২০১৬ রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতির উন্নয়নে গঠন করেন ‘রাখাইন উপদেষ্টা কমিশন’। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত ঘানার নাগরিক কফি আনানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশন ‘আনান কমিশন' নামে পরিচিতি পায়। এ কমিশনের ৬ জন সদস্যই ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক। ২৪ আগস্ট ২০১৭ কমিশন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ করে ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে মিয়ানমারের সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তভাবে বন্ধ করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ৫টি প্রস্তাব পেশ করেন ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সংকট হলো রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতৃত্ব বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও এখন পর্যন্ত রাশিয়া, ভারত ও চীন এ সংকট সমাধানে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চোরাবালিতে পড়েছে ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url