বাংলা রচনা : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন : সমস্যা ও প্রতিবিধান

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন : সমস্যা ও প্রতিবিধান

সূচনা : গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত প্রধান সমস্যাসমূহের অন্যতম । বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি-যার ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে এবং বিশ্ব নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ গ্রিনহাউস ইফেক্ট। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা পায়। আর কালের আবর্তের সাথে সাথে পরিবেশ দূষণের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেই বলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং ।

গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া প্রভৃতি থেকে ক্রমবর্ধমান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস। একদিকে পরিবেশ দূষণ ও অপর দিকে বনভূমি উজাড় করার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই- অক্সাইড শোষিত হচ্ছে না। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে একদিকে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত তাপ সঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সম্ভাব্য প্রভাব বা সৃষ্ট সমস্যাসমূহ : জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য ভৌত অভিঘাতসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো প্লাবন, নদীপ্রবাহের ক্ষীণতা, খরা, আকস্মিক বন্যা, সাইক্লোন ঝড়, নদীভাঙন প্রভৃতি ।

ক. প্লাবন : বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হলে দেশে বৃষ্টিপাত বাড়বে। এতে বর্ষাকালে নদ-নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, ফলে দেখা দেবে বন্যা। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ‘ব্যাক ওয়াটার ইফেক্ট' (Back Water effect) যুক্ত হলে নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করবে ।

খ. নদ-নদীর ক্ষীণ প্রবাহ : যে কোনো কৃষিপ্রধান দেশের জমিতে সেচ ও নৌচলাচলের জন্য নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে। ফলে সামুদ্রিক লোনা পানি সহজে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপ্রবাহে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে এবং দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করবে ।

গ. আকস্মিক বন্যা : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে আকস্মিক বন্যা হতে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল, কিউবাসহ অনেক দেশে আকস্মিক বন্যার প্রকোপও দেখা দিয়েছে। 

ঘ. খরা : কোনো এলাকার মাটিতে আর্দ্রতার অভাব তথা বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে খরা দেখা দেয় । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যদি উষ্ণতা বেড়ে যায় তাহলে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড খরায় অনেক দেশেরই চাষাবাদযোগ্য উর্বর ভূমি বিরানভূমিতে পরিণত হবে, মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুত এলাকা মারাত্মক খরা উপদ্রুত এলাকায় পরিণত হবে । 

ঙ. সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস : সাধারণত সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত বায়ু ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পানির উত্তাপও বৃদ্ধি পায়। তাতে ঘূর্ণিঝড়ের পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায় ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে প্রতিবিধান : জলবায়ুর পরিবর্তনের সম্ভাব্য যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মোকাবিলার জন্য আমাদেরকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে :

ক. জ্বালানির ফলে পরিবেশের যে দূষণ হয় তা প্রতিরোধের জন্য দূষণমুক্ত জ্বালানি প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের আরো দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হতে হবে । 

খ. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে মানুষকে অবহিতকরণের নিশ্চয়তা বিধানের নিমিত্তে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার, বিজ্ঞানী এবং আঞ্চলিক ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিবিড় সহযোগিতা আবশ্যক ।

গ. দুর্যোগ লাঘবের জন্য সতর্ক পরিকল্পনা ও পরিবেশের প্রতি দরদ নিয়ে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেজন্য পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে বিশ্বকে নিস্তার দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ।

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ

১. অ্যাকশন প্ল্যান : ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনে প্রথম পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান (Action plan) গ্রহণ করা হয়। এ অ্যাকশন প্ল্যানে ১০৯টি সুপারিশ গৃহীত হয় পরিবেশগত সমস্যাবলি সমাধানের জন্য। জনসচেতনতা সৃষ্টি করে পরিবেশ দূষণ রোধ করা, পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মকানুন গঠন করা এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এগুলোই মূলত অ্যাকশন প্ল্যান এর অন্তর্ভুক্ত।

২. বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত : জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত ১ম সম্মেলনেই ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । মানুষকে বারবার পরিবেশ সম্বন্ধে মনে করিয়ে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য ।

৩. পরিবেশবিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা : জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত প্রথম সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ছিল তা হলো পরিবেশ রক্ষার জন্য ইউএনইপি (United Notion Environment programme - UNEP) গঠন। ইউএনইপি সাধারণত বায়ুমণ্ডল, আবহাওয়ার পরিবর্তন, ওজোন স্তরের ক্ষয়, জীববিজ্ঞান-সম্পর্কিত তথ্য, রাসায়নিক নিরাপত্তা বিভিন্ন বিষয়ে প্রকল্প হাতে নেয়, যাতে পরিবেশগত সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হয় ।

৪. Rio-declaration on Environment and Development : ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে Rio-declaration on Environment and Development গৃহীত হয়। এখানে ২৭টি মূলনীতি ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেকসই উন্নয়ন পরিবেশগত সমস্যা নিরসনে বিশ্ব অংশীদারিত্ব, ক্ষতিকর বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমনে বাধা, সামর্থ্য অনুযায়ী সকলের প্রচেষ্টা ইত্যাদি ।

৫. কিয়োটো প্রটোকল : ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে তৃতীয় COP সম্মেলনে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের উদগীরণ কমানোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

৬. গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠন : ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো একটি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠনের অঙ্গীকার করেছিল । ২০২০ সালে তা প্রদান করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য এ তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করা হয় ।

৭. প্যারিস চুক্তি : প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলন শেষে ৩২ পৃষ্ঠার একটি চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বের ১৯৫টি রাষ্ট্র। এই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখার লক্ষ্য গৃহীত হয়েছিল । চুক্তিটি ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হয় । 

উপসংহার : ধনী, দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল সকল দেশকে একযোগে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। তবে অগ্রণী ভূমিকা হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত বিশ্বের সহায়তা আদায় করার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url