বাংলা রচনা : ই-কমার্সের যুগে বাংলাদেশ

ই-কমার্সের যুগে বাংলাদেশ

ই-কমার্সের যুগে বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে বলতেই হয়। সরকারের জোরালো পদক্ষেপের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিজিটাল বা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, জনসেবাসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় পরীক্ষামূলকভাবে ১২ ডিসেম্বর ২০২১ রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে 'ফাইভ-জি সেবার উদ্বোধন করেন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম অপারেটর ‘টেলিটক' বাংলাদেশ লিমিটেড চীনের প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের সহযোগিতায় ‘ফাইভ-জি' সেবা চালু করে। ইতোমধ্যে সারা দেশের সকল ইউনিয়নকে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করা হয়েছে, যা প্রান্তিক পর্যায়ের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিকট জীবন ঘনিষ্ঠ নানাবিধ বিষয় যেমন- পরীক্ষার ফলাফল, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য, চাকরিবিষয়ক তথ্য, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ই-মেইল যোগাযোগ, জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিবিধ সরকারি সেবা প্রদানে সহায়তা করছে।

ই-কমার্স হলো ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন ব্যক্তিগত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করে ওয়েব ও ইলেক্ট্রনিক ডাটা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সকল প্রকারের ভৌত এবং ডিজিটাল পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় করাকে বোঝায়। এটি মূলত অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনার একটি আধুনিক ডিজিটাল মাধ্যম, যা সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন, ব্যবসায়িক লেনদেন ও যোগাযোগ সহজীকরণ এবং সারাদেশে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। ক্রমবিকাশমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে ই-কমার্সের পরিধি এবং জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলেছে ।

ই-কমার্স খাতের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিকগুলো হলো :

ক. আন্তর্জাতিক মূল্য প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি;
খ. বিশাল বাজারে প্রবেশ ও গবেষণার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি;
গ. অভ্যন্তরীণ বাজারের দক্ষতা উন্নয়ন ও বৃদ্ধি;
ঘ. সহজ ও স্বল্প লেনদেন ব্যয়;
ঙ. নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি; 
চ. এসএমইসহ চাহিদাভিত্তিক নতুন শিল্পায়ন; 
ছ. ক্ষেত্রভিত্তিক নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সৃষ্টি; 
জ. অধিকতর নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি;

বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ : ফ্রান্সের এক জরিপে দেখা যায় যে, ই-কমার্সের ব্যবসা পরিচালনার প্রকৃতির কারণে একটি চাকরি হারালে ২.৪ টি নতুন চাকরি প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয় ।

এক জরিপে দেখা গেছে, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশেও আনুপাতিক হারে তরুণদের সংখ্যা সর্বাধিক বৃদ্ধি পাবে। এ প্রেক্ষিতে ই-কমার্স খাত বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে বাংলাদেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, বাংলাদেশ 'Next Eleven' গ্রুপের অন্যতম সদস্য হিসেবে সামর্থ্য ও সম্ভাবনার কারণে ২১-শতকের অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে ।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫% মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। সংখ্যার দিক থেকে তাই বাংলাদেশ শুধু বৃহৎ (জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে ৮ম) নয়; বরং যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ একটি দেশ। প্রতি বছর গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭% এর উপরে এবং বর্ধিষ্ণু নগরায়ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ই-কমার্স কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি হবে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের বর্তমান অবস্থা : UNCTAD ১৩০টি দেশের ই-কমার্স খাতসমূহ নিরীক্ষান্তে B2C E- commerce Index প্রস্তুত করেছে। এতে দেখা যায় যে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা একটি দেশের ই-কমার্স খাতের অবস্থান নির্ণয়ের প্রধান সূচক হিসেবে কাজ করে । দেশে ই-কমার্স কর্মকান্ড দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি মাসে নতুন নতুন সাইটের আগমন ঘটছে। যদিও এ খাতের বর্তমান অবস্থা এবং ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে খুব একটা গবেষণা পরিচালিত হয়নি; তবে Kaymu.com.bd সম্প্রতি প্রকাশিত 'A Report on E-commerce Trends in Bangladesh' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত ধীরে ধীরে উন্নতি করছে। Kaymu এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ই-কমার্স খাতে লেনদেন প্রতিবছর কমপক্ষে ১০% বৃদ্ধি পাবে। ই-কমার্সের ক্রেতারা মূলত শহরকেন্দ্রিক; তন্মধ্যে ৮০% ক্রেতা ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের। এদের মধ্যে ৩৫% ঢাকার, ৩৯% চট্টগ্রামের এবং ১৫% গাজীপুরের অধিবাসী। অন্য দুটি শহর হলো ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ এবং আরেকটি মেট্রোপলিটন শহর সিলেট। ৭৫% ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪-এর মধ্যে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত বিকাশের চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের সুনির্দিষ্ট কতিপয় চ্যালেঞ্জ নিচে তুলে ধরা হলো :

– ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা না থাকা,
– ই-কমার্স উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের অভাব;
– আর্থিক লেনদেনের অনিরাপত্তা;
– ধীরগতিসম্পন্ন ও ব্যয়বহুল ইন্টারনেট;
– ত্রুটিযুক্ত ডেলিভারি চ্যানেল;
– ইন্টার-অপারেবল অবকাঠামোর অপ্রতুলতা;
– দক্ষ ই-কমার্স প্রযুক্তি সহায়ক প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও মানবসম্পদের অভাব;
– আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশের অভাব;
– অনলাইনে কেনাকাটায় জনসাধারণের অভ্যস্ততার অভাব ও ভীতি;
– ভোক্তা অসন্তোষ নিরসনের সুনির্দিষ্ট মেকানিজমের অভাব;
– ই-কমার্স খাতে ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানে অনীহা;
– ই-কমার্স খাতের বিকাশে কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ না থাকা;
– পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাব ইত্যাদি ।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রয়োজনীয়তা : বর্তমান ডিজিটাল যুগে ই-কমার্স কি তা কাউকে আর বোঝানোর প্রয়োজন নেই । ই- কমার্স মানে ইলেক্ট্রনিক কমার্স। তবে সাধারণত সেবা ও পণ্যের বিবরণ, বিপণন, বিক্রয় অথবা সরবরাহ ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক উপায়ে সম্পাদনের নামই ই-কমার্স । ই-কমার্স বাংলাদেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বা সেবা একদম ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে ই-কমার্সের মাধ্যমে ।

ই-কমার্স বর্তমানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে যথেষ্ট ভুমিকা পালন করতে পারে । বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার প্রস্তুতি চলছে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ই-কমার্স এর অবদানও কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ই-কমার্স অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, তারা ই-কমার্সে অনেক এগিয়ে। ই-কমার্স মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে। আর এই ই-কমার্সের মাধ্যমে মানুষের কাজ অনেক সহজ হয় এবং অনেক সময় বাঁচানো যায় । ই-কমার্স শুধু কাজকে সহজ ও সময় বাঁচায় না, এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হয়। অনেক শিক্ষিত মানুষ চাকরি না পেয়ে হতাশার সাগরে বসে থাকে। স্বল্পপুঁজির মাধ্যমে ই-কমার্স সাইট তৈরি করে নিজে যেমন সাবলম্বী হওয়া যায় তেমনি অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয় । এভাবে ই-কমার্স বেকারত্ব দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে ।

মোটকথা, ই কমার্স বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির জন্য একটি অন্যতম হাতিয়ার। এর মাধ্যমে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তেমনি সময় বাঁচিয়ে কাজ অনেক সহজে করা সম্ভব হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url