বাংলা রচনা : ফাইভ জি যুগে বাংলাদেশ
ফাইভ জি যুগে বাংলাদেশ
ভূমিকা : মোবাইল ফোনের পঞ্চম প্রজন্মের (Fifth Generation) ইন্টারনেটকে সংক্ষেপে বলা হয় ফাইভ জি (5G)। ফোর জির তুলনায় অনেক দ্রুতগতিতে ইন্টারনেট থেকে তথ্য ডাউনলোড-আপলোড করা যায় এই ফাইভ জি সেবায় । হাইফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়ে থাকে ফাইভ জি মোবাইল নেটওয়ার্কে। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে একই সময়ে অনেক মোবাইল ফোনে দ্রুতগতিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সেবা বিশ্বের বেশ কিছু বড় দেশে ইতোমধ্যে চালু রয়েছে। যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এই সেবাকে আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, সেটি নিয়েও কাজ করছে দেশগুলো। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও অনেক দেশ এই সেবার সঙ্গে যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ফাইভ জি নেটওয়ার্ক চালু হয় ।
বাংলাদেশে ফাইভ জি সেবা চালু : ১২ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বা ফাইভ জি চালু হয় । প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় পরীক্ষামূলকভাবে এই সেবার উদ্বোধন করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটক উচ্চ গতিসম্পন্ন এই প্রযুক্তি সবার আগে চালু করে। বেসরকারি অপারেটররা ২০২২ সালের মার্চে তরঙ্গ নিলামের পর ক্রমান্বয়ে এই সেবা চালু করতে পারবে। টেলিটক পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ৬টি জায়গায় এই সেবা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, সচিবালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এবং সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। টেলিটকের ৬৫ লাখ গ্রাহককে এই সেবা পাওয়ার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ফাইভ জি সেবা দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটককে ২,১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিটি তাদের নেটওয়ার্ক আধুনিকায়নে ব্যয় করবে। টেলিটকের পর ২য় অপারেটর হিসেবে গ্রামীণফোন ২৬ জুলাই ২০২২ ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি স্পর্টে ফাইভ জি সেবা চালু করে ।
ফাইভ জি ও জীবনযাত্রার উন্নয়ন : টু জি'র (দ্বিতীয় প্রজন্ম) পর থ্রি জি (তৃতীয় প্রজন্ম) ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করেই বদলে যায় প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রা। পরবর্তীতে ফোর জি (চতুর্থ প্রজন্ম) এসে গতিশীল করেছে বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশন। ফাইভ জি প্রযুক্তি ফোর জি প্রযুক্তির চেয়ে ২০ গুণ বেশি গতিতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় । ফাইভ জি প্রযুক্তি মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা বদলে দেবে। ফাইভ জি প্রযুক্তির মাধ্যমে চালকবিহীন গাড়ি চলবে রাস্তায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আরও শক্তিশালী হবে। স্মার্ট সিটি বিনির্মাণ সহজ হবে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকা রোবট পরিচালনা করা যাবে। বাড়বে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) প্রযুক্তির ব্যবহার । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পানির মিটারের সাথে থাকা সেন্সরটি আরেকটি সেন্সরকে সতর্ক করে দেবে যখন খুব বেশি পানি ব্যবহৃত হবে, সরবরাহ বন্ধ করে দেবে, রিসোর্স ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়াবে, কিংবা কোনো ড্রোন সেকেন্ডের ব্যবধানে যেকোনো কিছুকে গুলি করে ভূপাতিত করতে পারবে। এই ব্যবস্থায় সেন্সরগুলোর ডাটা স্থাপিত হবে ট্রাফিক লাইটে, ঘরে, অফিসে, থানায়, পাবলিক পার্কে। ফলে নগর ব্যবস্থাপনা হবে আরও সহজ। এছাড়া বিগডাটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে ফাইভ জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফাইভ জি নেটওয়ার্কে গেমিংয়ে কোনো প্রকার ল্যাগ ছাড়াই খেলা যাবে। বাফারিং ছাড়াই অনলাইনে হাই রেজ্যুলেশনের ভিডিও দেখা যাবে। একই সঙ্গে ডিস্টার্ব ছাড়াই আরও উন্নত ও স্বচ্ছভাবে ভিডিও কল করা যাবে। লাইভ ম্যাপ ও ট্রাফিক তথ্য জানার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এই ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সেবা।
চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে উন্নয়ন : ফাইভ জি চালু হওয়ায় আমূল পরিবর্তন আসবে চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে। ফাইভ জি প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবার উন্নয়নের ফলে গ্রামে বা প্রত্যন্ত এলাকায় বসেও রোগী শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবেন। চাইলে বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎকের কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারবেন। এমনকি দেশের চিকিৎসকের পাশাপাশি বিদেশের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গেও পরামর্শ করা যাবে । ফাইভ জি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস করতে পারবে দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরাও। অর্থাৎ হাতের মুঠোয় চলে আসবে বিশ্বের নামিদামি সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস। দূর শিক্ষণ বা অনলাইন ক্লাসরুমের ফলে দূরগ্রাম বা প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে। ফাইভ জি ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তিগত বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করবে ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার উন্নয়ন : টু জি, থ্রি জি ও ফোর জিকে ব্যক্তিগ্রাহক পর্যায়ের ডিজিটাল বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ফাইভ জিকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব । অর্থাৎ ফাইভ জি সেবা বেশি কাজে লাগবে ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায়। এ লক্ষ্যে পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone)-এর শিল্প কারখানায় ফাইভ সেবা দেওয়ার জন্য বিটিসিএলকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে ।
আমাদের সীমাবদ্ধতা : টেলিকম বিশেষজ্ঞদের মতে, ফাইভ জিতে যাওয়ার আগে অবকাঠামো তৈরি জরুরি। ফাইভ জি ব্যক্তির জন্য নয়, এটি হবে সমাজের জন্য । এর ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সব সেবা চলে যাবে । বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বৃহৎ শিল্প-গার্মেন্টস শিল্পের মতো শিল্প কারাখানায় । এজন্য ইকোসিস্টেম উন্নত করতে হবে। প্রচুর ফাইভ জি টাওয়ার লাগবে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখনও ৩৫ শতাংশ ছাড়ায়নি। দেশে ফাইভ জি সেবা সম্বলিত হ্যান্ডসেটের স্বল্পতা থাকায় অনেকেই এ সেবা পাবেন না। কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর মতে, ‘ফাইভ জি পুরোপুরি চালুর আগেই দেশে ডিভাইস সংকট থাকবে না। এখনই দেশে ফাইভ জি স্মার্টফোন তৈরি হচ্ছে । চাহিদার ৯০ শতাংশ ফোর জি স্মার্টফোন এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে ।'
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে দেশে ফাইভ জি নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। এ নেটওয়ার্ক অটোমেশন, ডিজিটালাইজেশন এবং ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (Industry 4.0) চালনার মতো সরকারের ডিজিটাল এজেন্ডাসমূহ বাস্তবায়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতসহ অন্যান্য খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অনন্য ভূমিকা পালন করবে ।