বাংলা রচনা : বাদল দিনে

বাদল দিনে

বাদল দিনে
[ অনুরূপ রচনা : বর্ষণমুখর দিন ]

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, বাদল দিনের রূপ, উপসংহার। ]

ভূমিকা : বাদলের এক দিন। দখিনা খোলা বাতায়ন পাশে দাঁড়িয়ে আছি। দমকা বাতাস। কেয়ার ঝোপে ফুটন্ত কেয়া। আজ সকাল থেকেই ঘন কালো মেঘে ভরে গেছে গোটা আকাশ। ঘোমটা পড়া নতুন বধূর মতো আকাশটা কেমন যেন মুখ গোমড়া করে আছে। মনে হচ্ছে কিছু বললেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু না, তা আর বলার প্রয়োজন হলো না। কিছু সময় পর মাথার ওপর থেকে অবিরাম, অবিরল, অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিধারা পড়তে শুরু করল। কানে আসছে তার একটানা আওয়াজ। সে আওয়াজ কখনো মনে হয় নদীর কুলুধ্বনি, কখনো মনে হয় পাতার মর্মর। আজকের দিনে বাদলের স্বর ও বাতাসের স্ত্র দুই মিলে-মিশে এক সুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এমনি বাদল দিনে হয়তো রচনা করেন—

 আদর গরগর           বাদর দরদর 
এ তনু ডরডর            কাঁপিছে থরথর 
নয়ন ঢলঢল            কাজলকালো জল
ঝরে লো ঝর ঝর। 

বাদল দিনের রূপ : বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বাদলের ধারা ঝরে রিমঝিম ঝরঝর। এর স্নিগ্ধ মাধুর্য মনকে দোলা “দেয়। তাইতো কবি কণ্ঠে ছন্দের দোলা লাগে—

“হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে।”

বর্ষার আকাশ যেন ছাই রঙের পাখির পালকের তৈরি তাই এর দৃশ্যও এত নরম; এত মোলায়েম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বর্ষণ প্রকৃতিকে উপলক্ষ করে বহু কবিতা রচনা করেছেন-

“ সকাল থেকেই বাদলের পালা শুরু আকাশ হারানো আঁধার জড়ানো দিন।
আজকেই যেন শ্রাবণ করেছে পণ শোধ করে দেবে বৈশাখী সব ঋণ। ”

কবি জ্ঞানদাস লিখেছেন—

“ রজনী শাওন ঘন ঘন দেওয়া গরজন রিমিঝিমি শব্দে বরিষে । ”

সকাল থেকে সূর্যের মুখ দেখিনি। ঘোলাটে পাংশু আকাশ। বাদলের ধারা থামেনি। দাঁড়িয়ে আছি আনমনে জানালার পাশে। মেঘ-মেদুর আকাশ, ঘন মেঘের গর্জন, ঝরঝর বৃষ্টির শব্দ। পাতার মর্মর ধ্বনি। তাল, তমাল, শাল, পিয়াল বনের ওপর দিয়ে গুরু গুরু মেঘের মাদল বাজিয়ে বাদলের উৎসব শুরু হয়েছে। বায়ুবেগে চলছে গাছে গাছে কোলাকুলি ও লতায় পাতায় লুকোচুরি খেলা। অদূরে শিমূল গাছ থেকে একঝাঁক ভেজা কাক ডাক ছেড়ে উড়ে এসে বসল পাশের জাম গাছটায়। সামনের মেঠো পথে ছাতা মাথায় গৃহপানে ধাবিত দু-একজন পথিক। মাঠের পরের ঝুপড়িটায় চুপটি করে বসে আছে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ডোবা পুকুরে বর্ষার ঘোলা পানি। তারই বুকে আনন্দ-মুখর ভেকের দল ডাকছে। গাছগুলো ভিজে ভিজে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। কবি বন্দে আলী মিয়া বাদলের এ রূপটাকে বর্ণনা করেন এভাবে—

“ দেয়া ঝর ঝর সারাদিন ধরি মেঘলা আকাশ হতে
গাছগুলো ভেজে চুপচাপ দাঁড়াইয়া কোনমতে। 

কোলাহলমুখর জনপদ আজ বর্ষার পরশে একেবারে নীরব নিস্তব্ধ। এমনি বর্ষণমুখর বাদল দিনে বৈষ্ণব পদকর্তা রাধার বিরহের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন—

“ এ ঘোর রজনী মেঘের ঘনঘটা কেমনে আইলে বাঁটে।
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিতে দেখিয়া পরাণ ফাটে। ”

ঝরঝর বৃষ্টির ধারা ঝরছে— মনে হয় আকাশটা যেন ফুটো হয়ে গেছে। কানে ভেসে আসছে অবিরাম বৃষ্টি পড়ার শব্দ। শরীরের লোমগুলো মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে উঠছে কি এক অজানা শিহরণে। বৃষ্টির শব্দকে মাঝে মাঝে নদীর কুলু ধ্বনির মতো মনে হয়। আবার কখনও পাতা ঝরার শব্দ বলে ভ্রম হয়। বৃষ্টির সাথে সাথে বইছে বাতাস। বৃষ্টির শব্দ কখনো কখনো দমকা বাতাসের সাথে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির এমন মধুর দিনে কোন এক অনির্বচনীয় আস্বাদ মনের মাঝে ভিড় করে তা সহজে অনুমান করতে পারি না। এমন দিনে হৃদয় কেন যেন কার নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। এলোমেলো বিক্ষিপ্ত মেঘের ঘোরে আটকা পড়ে সময়ের চাকা। কবি জসীম উদ্দীনের কথাকে তখন যথার্থ বলে মনে
হয়-
“এদিকে দিগন্তে যতদূর চাহিদা, পাংশু মেঘের জাল।
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল । ”

আরাম কেদারায় বসে পড়লাম। চিবুতে লাগলাম ঝালমুড়ি। চেয়ে রইলাম দূর-দূরান্তের পথে। মনে পড়ল মেঘদূতের কল্পকাহিনী, বৈষ্ণব পদাবলির অপূর্ব কীর্তন, রবীন্দ্রনাথের বর্ষবরণ কবিতা। চোখে ভেসে উঠল মেঘের যাত্রাপথ। সে-ই উজ্জয়নী অবন্তি, শ্রাবস্তী এবং বিদিশা নগরী। সেই রেবা, শিপ্রা নদীর কথা।
চারিদিকে আজ বর্ষার সন্ধ্যা প্রকৃতির অবিশ্রান্ত দাপাদাপি, মাতামাতি। প্রকৃতির এ রূপ অপরূপ হয়ে মানব মনে গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে।

স্মৃতিকে জাগ্রত করে হারানো দিনের অব্যক্ত স্মৃতিকথা। এমনি ভাব-বিহ্বল পরিবেশে কবি গুরু গেয়েছিলেন ー
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।

বর্ষাকে নিয়ে লেখা ও আঁকা অনেক কবিতা, গান ও ছবি মানব মনকে বর্ষা প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে দেয়। বাদল দিনের বর্ষণমুখর পরিবেশে মনের কোণে অনেক বিস্মৃত খণ্ড খণ্ড স্মৃতি ভেসে উঠছে। এগুলো একান্ত নিজের। অপরের কাছে এর মূল্য নেই। হয়তো এমনি ভেজা সোঁদা গন্ধময় পরিবেশেই কবি শেলী রচনা করেছেন "Ode to the west wind. আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে সূর্যের সোনালি হাসি পড়েছে ঢাকা। নীল আকাশ হয়েছে বিলীন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই রচনা করেন ー

“ নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে
বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর
আউসের ক্ষেত জলে ভর ভর
কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। ”

ধরণীর বুকে নেমে আসছে ঘন অন্ধকারের ভয়ঙ্কর জটাজাল। তবু এ রূপমাধুরী আমার হৃদয়ে দেয় অপূর্ব দোলা। সৃষ্টি করে ভাবালুতা। বাদলের মায়াবী আকাশ দুনয়নে যেন মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দেয়। আমার হৃদয় কন্দরে অসংখ্য ভাবনা অগোছালো অবিন্যস্তরূপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বর্ষার মুখ দেখে তাইতো বারে বারে আমার মন হয় উদাস, উন্মনা। কেন যেন ভালো লাগে সবকিছু, পৃথিবী, প্রকৃতি এমনকি বাঁশ ঝাড়ের বর্ষা ভেজা চিলটিকেও। তাই মনে মনে গুণ গুণ করে গান গাইতে লাগলাম ー
“ বরষারে, তুই মোর শ্যাম সমান
মেঘ জটাজাল উড়িয়ে আকাশে
ঝম ঝম গাও তুমি গান তুমি মোর শ্যাম সমান। ”

উপসংহার : যান্ত্রিক জীবনের শত কর্মব্যস্ততার মাঝে আজকের এ বাদল ঝরা দিন আমার স্মৃতির মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে, যদিও আজকের বৈকালিক ভ্রমণ, খেলা ও আড্ডা বন্ধ হয়ে রয়েছে। শুধু দেখলাম, অনুভব করলাম বাদল দিনের মৌন প্রকৃতিকে। আর আমার স্মৃতির মন্দিরে হাজার কথা-কাহিনী, অনুরাগ-বিরাগ এসে জড়ো হলো।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url