বাংলা রচনা : সে একটি নদীর আত্মকাহিনী
সে একটি নদীর আত্মকাহিনী
[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, বর্ণনা, উপসংহার। ]
ভূমিকা : আমার নাম পদ্মা। আমি একটি নদী। তোমাদের এক কবি আমাকে ডেকেছিলেন বাংলাদেশের আদুরে সলিল কন্যা নামে। বেশ কাব্য করে তুলে ধরেছিলেন আমার রূপ। আমি নাকি এক অনন্ত যৌবনা, চির কৌতুকময়ী মেয়ে। তিনি আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে আমার আনন্দ-বেদনার কথা তাঁকে শোনাতাম। কি ভাই, তুমিও কি শুনতে চাও আমার কাহিনী। বেশ তাহলে শোন—
বর্ণনা : আমার নামতো তোমাকে আগেই বলছি। এ নামটা কে যে আমায় দিয়েছে জানিনে। তবে আমার আরেকটা নাম আছে। তা হলো—— গঙ্গা, আজ থেকে প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে আমার জন্ম। হিমালয় পর্বতমালাকে তো নিশ্চয়ই চেনো। সেই হিমালয়ের কুমায়ূন পাহাড়ই হচ্ছে আমার জন্মস্থান। ওখানকার এক জায়গার নাম তেহরি গাহড়োয়াল, তার কাছে আছে একটি পাহাড়, তার নাম গোমুখী। সেখান থেকে বেরিয়ে আমি পড়েছি গঙ্গোত্রি হ্রদে। এ গঙ্গোত্রি থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। সুদৃঢ় পাহাড় থেকে নেমে এসেছি সমতলে।
পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে যখন সমতলে নেমে আসছিলাম তখন আমার মনে-প্রাণে সেকি তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। প্রথমে আমি বেশ হালকা-পাতলাই ছিলাম। তারপর যতই অগ্রসর হতে থাকলাম, ততই চওড়া হতে লাগলাম। আমার বেগগবান স্রোতের ধাক্কায় দু'পাশের মাটি রূপ ঝুম দুম দুম করে ভাঙতে থাকে, আর আমিও ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। দু'পাশে কত বাড়ি-ঘর, কত আবাদি জমি, সবুজ শস্যের ক্ষেত, কত বনপ্রান্তর। বনের গাছেরা আমায় আদর করে উপহার দেয় লতা-পাতা, ফুল; আমি তা আনন্দে গ্রহণ করি। আমার সুশীতল কোলে একটুখানি অবস্থান করে অনেকে শ্রান্তি মেটায়। আমার পবিত্র জলে স্নান করে অনেকে পবিত্র হয়। কিশোর-কিশোরীরা হৈ হুল্লোড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে। কত মাঝি লাল নীল পাল উড়িয়ে ভাটিয়ালি সুর তুলে আমার বুকের উপর দিয়ে কত দূরে চলে যায়। কত জনে আমাকে কত দুঃখের কথা বলে। আমি সব কান পেতে শুনি ।
তোমাকে আমার চলার গল্প শুনাতে গিয়ে কেমন আবেগে উদ্বেল হয়ে পড়েছি। শুন তারপর ভারতের বিস্তৃত সমভূমির উপর দিয়ে চলতে চলতে আমি বাংলাদেশের রাজশাহীর কাছে এসে গেলাম। এখানে আমি দুপাশে বিভক্ত হলাম। এক অংশ পদ্মা নাম নিয়ে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হলাম। আরেক অংশ ভাগিরথী নাম ধরে চলে গেলাম পশ্চিম বঙ্গের উপর দিয়ে। এবং জন্যেই এক সংগীত রসিক আমাকে নিয়ে গান বেঁধেছেন তুমি কি শুননি সেই গানটি? ঐ যে—
এই গঙ্গা সেই পদ্মা
যা হোক, এ পদ্মা নামটিই বেশি জনপ্রিয়। কত কবি, কত সাহিত্যিক যে নামটি ব্যবহার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বাংলা ভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে নিয়ে লিখেছেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি' নামের এক বিখ্যাত উপন্যাস। আমার তীরে বসবাসকারী যে সব জেলেরা আমার বুকে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের জীবন কথা লিপিবদ্ধ আছে তাতে। তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের সংস্কৃতি, তোমাদের জাতীয় ঐতিহ্য এবং চেতনার সাথে মিশে আছে আমার নাম। আমি আছি তোমাদের সত্তার গভীরে।
এ দেখ, আমার নিজের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে কত শক্ত শক্ত কথা তোমাকে বলে ফেললাম। আসলে কি জান, পরের জন্যে যে জীবন উৎসর্গ করা যায় না— সে জীবন নিরর্থক। আমার বুকে যখন সারি সারি নৌকা চলে, আমার দু'পাড়ে যখন বন্দর গড়ে ওঠে, তীরে তীরে সোনালি শস্যের ক্ষেতে যখন দখিনা বাতাস ঢেউ খেলে যায় তখন আমার কি যে আনন্দ লাগে। এই যে তোমরা শহর, নগর, বন্দর, গ্রামগঞ্জ গড়ে তুলছো, সেতো আমারই কল্যাণে। একথা আমি যখন ভাবি, তখন গর্বে আমার বুক ভরে যায়।
আমার চলার গল্পটা তোমাকে বলছিলাম। তারপর শুনো। আমি যখন গোয়লন্দে পৌঁছলাম তখন আমার সাথে এসে মিশে গেল যমুনা নদী। প্রাণবন্ত ধারাকে আমি বুকে জড়িয়ে নিলাম। তারপর ছুটলাম চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। চাঁদপুরে পৌঁছে আমি মেঘনার সাথে মিলে যাই। তারপর মেঘনা ও আমার সম্মিলিত ধারা মিশে যায় অনন্ত সাগরে। আমি তো একদিন তুষার রাজ্যে ছিলাম। কি করে যে এত শক্তি পেলাম, বুঝতেই পারিনি। শুরুতে কেবল ‘হেসে খলখল গেয়ে কলকল' রবে এগিয়েছি আর এগিয়েছি। পরে বুঝেছিলাম, সাগর আমায় ডাকছে। তার কাছে আমার যেতেই হবে।
তোমরা তো জান একই সঙ্গে আমার অনেক রূপ। আমি কখনো প্রশান্ত, কখনো অশান্ত। কখনো প্রলয়ঙ্করী, কখনো অভিমানিনী। একেক সময়ে আমি একেক রূপ ধারণ করি। ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সাথে বদলে যায় আমার চেহারা, বদলে যায় আমার মন। বৈশাখে দেখ আমার ভয়ঙ্কর মূর্তি। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড হাওয়া যখন লাগে আমার বুকে তখন আমিও কেমন ক্ষেপে যাই। আমার বুকেও তখন শুরু হয় গর্জন। আমার বুকের ঢেউগুলো দারুণ রোষে তখন ফুলতে থাকে। ঢেউগুলো গর্জন করতে করতে পাড়ে গিয়ে আঘাত করে। এ আঘাতে ভাঙে পাড়, ভাঙে ঘরবাড়ি। এ সময় আমার বুকে ডুবে যায় কত নৌকা, ডুবে যায় কত মানুষ। বর্ষায় আমার বুক আরও ভরে যায়। পর্বত থেকে আসে আরও পানি। এত পানির স্থান সংকুলান হয় না আমার বুকে। তখন আমার দু' তীর প্লাবিত হয়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, ফসলের ক্ষেত, গ্রাম, গঞ্জ তখন আমি জবরদখল করি। শরতে আমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসি। আমার দু' তীরে তখন কাশবন জেগে ওঠে। হেমন্তে এ কাশবনগুলো সাদা সাদা ফুলে ভরে যায়। এ সময় আমার বুকে আরও চর জেগে ওঠে। শীত এলে আমি হয়ে যাই আরো শীর্ণ। এ সময় কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাই আমি সারা রাত।
আমি চলছিতো, চলছিই। চলা ছাড়া আমি আর অন্য কিছু জানি না। চলা আমার ধর্ম, চলা আমার জীবন। কিন্তু তোমরা মানুষেরা আমার চলার ছন্দে মাঝে মাঝে বাধার সৃষ্টি কর। বাংলাদেশে প্রবেশের পথে তোমরা আমার উপর বাঁধ তৈরি করেছ। তোমাদের গড়া এ ফারাক্কা বাঁধ আজ মরণ ফাঁদ হিসেবে পরিগণিত। আমার চলার সহজ ছন্দকে কেড়ে নিয়ে ভারত সরকার আমার জল নিয়ে রাজনীতি করছে। আমি স্বাধীনভাবে আর প্রবাহিত হতে পারছি না। আমার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এটি আমার দারুণ অপছন্দ। আমার তীরের লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ জলের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তাদের আবাদি জমি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। জলের জন্যে তারা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমি তাদেরকে আমার শান্ত সুশীতল ধারা দান করতে পারছি না। এটি কি আমার কাছে কম কষ্টের বিষয়। বাংলাদেশ সরকার আমার জলের জন্যে কত বৈঠক, কত আবেদন নিবেদন করছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ওহে মানুষেরা, তোমরা এত স্বার্থপর কেন ?
আমি কিন্তু তোমাদের মতো অমন স্বার্থপর নই। তোমাদের মতো অমন নোংরা রাজনীতি আমি বুঝি না। তবে ক্ষেপে গেলে একটু ভয়ঙ্কর হই, এই যা। তোমরা বল আমার বুকে যখন বান ডাকে তখন আমি নাকি কেমন হয়ে যাই। কিন্তু তোমরাই বল, এজন্যে কি আমি দায়ী? তবে হাঁ, চলার পথে যদি কিছু পড়ে তবে তাকে ধ্বংস করেই আমাকে পথ করে নিতে হয়। বেশ কিছুদিন আগে মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের অনেক জায়গা ভেঙ্গে আমি আস্তে আস্তে পূর্বদিকে এগিয়ে যাই। এর ফলে অনেক বড় বড় দালান-কোঠা ধ্বংস করেছি আমি। তাই তোমরা আমাকে নাম দিয়েছ কীর্তিনাশা। কিন্তু যেদিকে আমার স্রোতের চাপ কম, সেদিকে আমি চলি না আর মাটি জমিয়ে চর বানিয়ে দেই। ভরা জোছনার মতো এ চর আমার বুকে খলবল করে হেসে ওঠে। পলি দিয়ে আমি জমিকে উর্বর করি। সে পলিযুক্ত জমিতে তোমরা ফলাও কত মূল্যবান ফসল। তাইতো তোমরা বলে থাক, বাংলাদেশের জন্যে আমি একটা আশীর্বাদ।
উপসংহার : তোমার সঙ্গে অনেক কথা হলো। হাসি কান্নায় ভরা আমার বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক কথা তোমাকে বললাম। তুমি হয়তো এখন চলে যাবে, কিন্তু আমি কুলু কুলু রবে বইতেই থাকব। এত জল আমার বুকে তবুও আমার অনেক তৃষ্ণা। বুকে আমার অনেক জ্বালা। আমার বুকে তোমরা যে কুলু কুলু ধ্বনি শুনতে পাও, ওটা আমার ব্যথার গান আমি গেয়ে চলি, শুধু গেয়ে চলি-
But I go and forever."