বাংলা রচনা : মেট্রোরেল
মেট্রোরেল
মেট্রোরেল প্রকল্প
যোগাযোগের নতুন দিগন্ত : মেট্রোরেল
ভূমিকা : বর্তমান সরকারের গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা মেট্রোরেল অন্যতম। বিশ্বের জনবহুল মেগা সিটিগুলোর মধ্যে ঢাকা জনসংখ্যার বিচারে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। ঢাকার ভয়াবহ যানজট ও ট্রাফিক সমস্যা দূর করার জন্য মেট্রোরেল প্রকল্প একটি সময়োচিত ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহনই হতে পারে একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা। মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) উত্তরা-মতিঝিল-উত্তরায় চলাচল শুরু হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২থেকে যাত্রীরা এ পথে চলাচল করতে পারে। পুরোদমে এ প্রকল্প চালু হলে যাত্রীদের সময় বাঁচবে, কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং শহরের যানজট কমাবে।
মেট্রোরেল কী : মেট্রোপলিটন রেল-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো মেট্রোরেল। মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো স্পর্শ করে গণপরিবহনের জন্য প্রতিষ্ঠিত রেলব্যবস্থাই মেট্রোরেল। এটি একটি বিদ্যুৎ চালিত পরিবহন। ঢাকা মেট্রোরেল ব্যবস্থার প্রকল্পটির নাম 'ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট'। এটি একটি দ্রুতগামী, স্বাচ্ছান্দময়, সুবিধাজনক ও নিরাপদ নগরকেন্দ্রিক রেলব্যবস্থা।
মেট্রোরেলের গুরুত্ব : জনবহুল রাজধানী শহর ঢাকা যানজটের শহর হিসেবেই বিশেষভাবে পরিচিত। এই শহরে সকাল-দুপুর-বিকেল-রাত সবসময়ই যানজট লেগে থাকে। এখানে বাস, ট্রাক, কার, অটোরিকশা, বাইক আর রিকশা মিলিয়ে কয়েক লাখ যান প্রতিদিন চলাচল করে। দুতিন ঘণ্টা আগে রওয়ানা হয়েও সঠিক সময়ে কখনো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। রাস্তায় যানজটে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খেতে হয় যাত্রীদের। ইতোমধ্যে সরকার বেশ কয়েকটি উড়াল সেতু, ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, লিংকরোড ইত্যাদি নির্মাণ করেছে। কিন্তু যানজট খুব একটা নিরসন হয়নি। এ কারণে যাত্রীদের সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বাসের অপেক্ষায়। সিএনজি বা রিকশা চালকদের হাতেও জিম্মি হতে হয় কখনো কখনো। ঝড়, বৃষ্টি বা হরতালের সময় মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এমতাবস্থায় মেট্রোরেল চালু হলে সময়ের অপচয় যেমন হ্রাস পাবে তেমনই নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ হয়ে যাবে।
মেট্রোরেলের কর্মপরিকল্পনা : ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ৬ টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড, ডিএমটিসিএল-এর আওতায় একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার নিমিত্ত সরকার সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৩০ গ্রহণ করেছে। এই কর্মপরিকল্পনা অনুসরণে উত্তরা উত্তর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৭টি স্টেশন বিশিষ্ট বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এখন শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উত্তরা উত্তর মেট্রোরেল স্টেশন হতে আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে মেট্রো ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে।
ঢাকা মেট্রোরেলের প্রথম রেলপথ এমআরটি লাইন-৬। বাংলাদেশের প্রথম এ দ্রুতগামী গণপরিবহন রেলপথ ২০২২ সাল থেকে সেবা প্রদান করে আসছে। এই সম্পূর্ণরূপে উড়াল রেলপথ উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন বর্তমানে চালু রয়েছে।
এমআরটি লাইন-৬ রেলপথ জামিলুর রেজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার পর্যালোচনা কমিটি কর্তৃক ঢাকায় দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর করার প্রস্তাব এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা- জাইকা’র প্রস্তুত করা শহুরে পরিবহন গঠন গবেষণার ফলাফল।
২০১৬ সালের ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা এই রেলপথের নির্মাণকাজ গুলশান হামলা ও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে কয়েকবার বিলম্বিত হয়।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর এর প্রথম পর্যায় (উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হবার ফলে উত্তরা থেকে সরাসরি মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলে চলাচল করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এমআরটি লাইন-৬ উত্তরে টঙ্গী ও সাভার উপজেলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হবে।
মেট্রোরেল প্রকল্প যেভাবে শুরু হলো : ২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে ঢাকায় একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য সুপারিশ করে। একই বছরে মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুই বার্জার গ্রুপ ঢাকার জন্য একটি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। বিশ্ব ব্যাংক এই খসড়া পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করলেও প্রথমে কোন দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার সুপারিশ ছিল না।
নির্মাণ প্রকৌশলী ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এই পরিকল্পনা পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে পর্যালোচনা দল পরিকল্পনায় দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পরে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা মেট্রোরেল প্রকল্পে যোগ দেয়। শহুরে পরিবহন গঠন গবেষণায় জাইকা প্রস্তাবিত রেলপথগুলোর মধ্যে এমআরটি লাইন ৬-কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। ২০১০–২০১১ অর্থবছরে এই লাইন নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়।
২০১১ সালে রেলপথের জন্য একটি খসড়া যাত্রাপথের মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়। মানচিত্র অনুযায়ী রেলপথটি উত্তরা থেকে সায়দাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিলো। প্রস্তাবিত বিজয় সরণি স্টেশন বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের সামনে নির্মিত হওয়ার কথা ছিলো, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে স্টেশনটি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়।
খসড়া যাত্রাপথে যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতু এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের অনুরোধে প্রস্তাবিত যাত্রাপথ উড়ালসেতু থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিলো। খসড়া যাত্রাপথে মেট্রো মিরপুর সেনানিবাসের উপর দিয়ে দেখানো হয়েছিল; তবে সেনাবাহিনী সেখানে একটি আবাসিক এলাকা নির্মাণ করতে চেয়েছিলো, তাই রেলপথটির অবস্থান এর থেকে পূর্বে সরিয়ে নেয়া হয়। রেলপথ তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা অতিক্রম করার কথা ছিলো, পরে জাতীয় সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার নির্দেশ দেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রধানন্ত্রীকে রেলপথের গন্তব্যস্থল সায়দাবাদের বদলে মতিঝিল করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি যাত্রাপথটি বাংলামোটরের মধ্য দিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে যাত্রাপথ মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনে বর্তমান মানচিত্র হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়।
জাইকা উত্তরায় প্রস্তাবিত তিনটি স্টেশন ভূমিতে এবং বাকি স্টেশনগুলো মাটির নিচে বানাতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভারতীয় গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ইলাত্তুভালাপে শ্রীধরন সমগ্র রেলপথ মাটি থেকে উঁচুতে নির্মাণ করার পরামর্শ দেন। কেননা তার মতে ভূগর্ভস্থ রেলপথ নির্মাণ ও দেখাশোনায় অনেক খরচ হবে।
এই পরামর্শের ফলে পুরো রেলপথ মাটি থেকে উঁচুতে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বরে এমআরটি লাইন ৬ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং পরবর্তী বছরে জাইকা নির্মাণ প্রকল্পের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে এবং এর পরিচালক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১৪ সালে প্রকল্প কর্মকর্তাগণ রেলপথের স্টেশনের নকশা প্রস্তুত করে ফেলে। একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার দুই বছর পর এর ধারণাগত নকশা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে সংশোধিত এসটিপির চূড়ান্ত সংস্করণে এই রেলপথসহ ঢাকায় মোট পাঁচটি দ্রুতগামী গণপরিবহন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।
লাইনটি নির্মাণের আগে উত্তরা-মিরপুর অংশে তিনটি বাধা পাওয়া যায়। প্রথম বাধা ছিল উত্তরা থেকে মিরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানীয় সড়কের সংকীর্ণতা, যার কারণে সেখানে নির্মাণ কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বাধা ছিলো উত্তরা ও মিরপুরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি হৃদ। তৃতীয়টি ছিলো প্রস্তাবিত যাত্রাপথে থাকা শ্রী শ্রী গৌড় নিতাই মন্দির যা সরানো দরকার ছিলো।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রথম বাধা দূর করতে সড়কটি প্রশস্ত করার পরিকল্পনা করে। দ্বিতীয় বাধার ক্ষেত্রে হ্রদের চিহ্নিত জায়গাগুলো ভরাট করে জায়গাগুলোতে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হওয়ার পর মাটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকার মন্দির কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করার পরে তারা মন্দির স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়, ফলে সব বাধা দূর হয়।
লাইনের যাত্রাপথটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিবাদে এর অবস্থান বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সামনে নেয়ার চিন্তা করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৭ জানুয়ারি ২০১৬ সাল থেকে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি মেট্রো স্টেশন নির্মাণের উপকারিতা তুলে ধরার পর তারা বিরোধিতা করা থেকে সরে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের হাসপাতালের সামনে দিয়ে রেলপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলো। তবে হাসপাতালের নিকটে একটি স্টেশন করা হলে রোগীরা উপকৃত হবে এমন আশ্বাস ডিটিসিএ দেয়ার পরে কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায় : ২০১৬ সালের ২৬ জুনে এর নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। রেলপথ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবানের সময় গুলশান হামলার ঘটনা ঘটে, ফলে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় কিছু কোম্পানি দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে চলে যায়। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৭জন জাপানি কর্মকর্তা এই আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন।
আক্রমণের ছয় মাস পরে সরকারের আশ্বাস পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণকাজে অংশ নেয়। লাইন ৬-এর পূর্ণাঙ্গ একটি নকশা ২০১৬ সালের আগস্টে প্রস্তুত করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে দিয়াবাড়িতে রেলপথের ডিপোর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ২ আগস্টে এমআরটি লাইন ৬-এর প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
নির্মাণকাজ শেষ করতে ডিএমটিসিএল সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আবদুল মোনেম লিমিটেড, যা ছিলো এই নির্মাণ প্রকল্পে নিযুক্ত একমাত্র বাংলাদেশি ঠিকাদার। এছাড়া প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের ঠিকাদার ছিলো ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট।
২০১৮ সালের মধ্যে যাত্রাপথের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের ইউটিলিটি স্থানান্তর শেষ হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে রেলপথের স্তম্ভগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে স্প্যান স্থাপন করা শুরু হয়। একই বছরের আগস্টে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণাধীন রেলপথের আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার অংশে অবস্থিত ভায়াডাক্ট ও স্টেশনের কাজ শুরু হয়। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল অনুযায়ী ২০ কিলোমিটার রেলপথের ৮.১৫ কিলোমিটার অংশের ভায়াডাক্ট বসানো শেষ হয়।
২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়তে থাকে, প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত বিদেশীরা কাজ করা বন্ধ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়। মহামারী চলাকালে লকডাউনের ফলে কয়েক মাসের জন্য নির্মাণকাজ বন্ধ থাকে। সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু নিয়ম জারি করা সাপেক্ষে সরকার নির্মাণকাজ চালানোর অনুমতি দিলে কাজ আবার শুরু করা হয়।
২০২১ সালে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঝে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দুটি অস্থায়ী চিকিৎসালয়, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র ও অস্থায়ী বাসভবন স্থাপন করে সরকার। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে রেলপথের প্রথম পর্যায়ের সব স্প্যান বসানো শেষ হয়। যাত্রাপথের সবগুলো ভায়াডাক্ট ২৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে শেয় হয়। ডিপোর নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়।
মেট্রোরেলে পরীক্ষামূলক চলাচল ও চালু করা : ডিএমটিসিএল দুটি পর্যায় ২০২৩ সালের মধ্যে চালু করার কথা ভাবে। ২০২১ সালের ২৯ আগস্টে নির্মাণাধীন রেলপথের উপর পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেই দিনে ট্রেন দিয়াবাড়ি ডিপো থেকে মিরপুর ১১ পর্যন্ত ভ্রমণ করে।
২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কর্তৃপক্ষ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সমন্বিত পরীক্ষামূলক চলাচল পরিচালনা শুরু করে। উত্তরা–আগারগাঁও অংশে মোট ৪টি পরীক্ষামূলক ট্রেন পরিবহন পরিচালনা করা হয়। এমআরটি লাইন ৬-এর উত্তরা–আগারগাঁও অংশ উদ্বোধনের তারিখ ২৮ ডিসেম্বরে ঠিক করা হয়।
২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে বাংলাদেশের এই প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত অংশটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এরপরের দিন জনসাধারণের জন্য প্রথম পর্যায়ের প্রথম ও শেষ স্টেশনের মধ্যে বিরতিহীনভাবে মেট্রো সেবা চালু হয়।
জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে আরো কিছু স্টেশন খুলে দেওয়া হয়। ৩১ মার্চ ২০২৩ সাল থেকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের নয়টি স্টেশনই ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিলে ওবায়দুল কাদের একই বছরের নভেম্বরে দ্বিতীয় পর্যায় চালুর খবর ঘোষণা করেন।
২০২৩ সালের ১৮ মে তারিখে একই বছরের জুলাই মাসে ডিএমটিসিএল আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু করার ঘোষণা দেয়। ৭ জুলাই ২০২৩ সালে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে প্রথম পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়।
প্রকল্প ব্যয় ও অর্থায়ন : এমআরটি লাইন-৬ এর অর্থায়নে জাইকা (৫৮.৭৮%) এবং বাংলাদেশ সরকার (৪১.২২%)। এমআরটি লাইন ৬ রেলপথের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশের নির্মাণকাজের জন্য ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। জাইকা এই অর্থের ৭৫.৪৫% ঋণ হিসেবে প্রদান করেছে। নির্মাণ বাবদ ০.৭০%, পরামর্শ সেবা বাবদ ০.০১% ও ফ্রন্ট এন্ড ফি বাবদ ০.২% সুদে সরকার এই ঋণ নিয়েছে।
ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এমআরটি লাইন ৬-এর সেবা চালুর দশ বছর পর্যন্ত আসল সমেত ঋণের সুদ প্রদান করতে হবেনা। রেলপথ চালুর ত্রিশ বছর মধ্যে সুদসহ সমস্ত টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে।
কমলাপুর পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ কাজের জন্য প্রকল্পের বাজেট অতিরিক্ত ১১ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ৩২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা করা হয়।
এমআরটি লাইন ৬ রেলপথ চালুর দিনে এটি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৭২ টাকা আয় করে। চালুর প্রথম দশ দিনে এটি ৮৮ লাখ টাকা আয় করে। চালুর প্রথম মাসে কোম্পানি রেলপথ থেকে ২.৪৫ কোটি টাকা আয় করে। প্রথম তিন মাসের মধ্যে ডিএমটিসিএল মোট ৬.২০ কোটি টাকা আয় করে।
১৯ জুন ২০২৩ সালে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ সরকারকে ঋণের কিস্তি হিসেবে ৫৫.৩০ কোটি টাকা প্রদান করে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী কোম্পানি এই লাইন থেকে দৈনিক ২৫ লাখ টাকা আয় করে থাকে।
ট্রেন : ২০১৭ সালে ডিএমটিসিএল এমআরটি লাইন ৬-এর প্রাথমিক অংশের সেবাপ্রদানের জন্য কাওয়াসাকি হ্যাভি ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ৪ হাজার ২৫৭.৩৪ কোটি টাকা অর্থমূল্যে ২৪টি ৬ কোচবিশিষ্ট যাত্রীবাহী রেলগাড়ি অর্ডার করে। ১৬ এপ্রিল ২০১৯ সালে রেল কোচগুলো উৎপাদন শুরু হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় মেট্রোর একটি নমুনা ট্রেন এসে পৌঁছায়। প্রথম ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২১ সালের এপ্রিলে পৌঁছায়। বাকি ট্রেনগুলো ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে পৌঁছে যায়।
এমআরটি লাইন ৬-এর রেলপথে বর্তমানে ১২টি ট্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে যেগুলো সব কাওয়াসাকির তৈরি। ট্রেনের প্রতিটি কোচ লম্বায় ১৯.৮ মিটার, প্রস্থে ২.৯৫ মিটার ও উচ্চতায় ৪.১ মিটার। কোচগুলো একসাথে ট্রেনে পরিণত হলে দৈর্ঘ্যে ১২০ মিটার হয়। ট্রেনগুলোর বিদ্যুতায়নে ওভারহেড লাইন ভিত্তিক ১৫০০ ভোল্ট ডিসি রেল ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে। দুটি শীতাতপ ইউনিট দ্বারা ট্রেনগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রতি সেকেন্ডে ৩.৫ কিলোমিটার পার আওয়ার গতি বাড়ানো ও কমানোর দক্ষতাসহ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেনগুলো ভ্রমণ করতে সক্ষম। ট্রেনের জানালায় বুলেটপ্রুফ কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে।
এ রেলপথের জন্য ১২টি ট্রেন বরাদ্দ আছে যার মধ্যে দুইটি ট্রেন ব্যাকআপ ট্রেন হিসেবে রাখা হয়েছে। রেলে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে মতিঝিল, উত্তরা ও শেওড়াপাড়ায় ১৩২ কেভির তিনটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ট্রেনের একটি করে কোচ শুধুমাত্র নারীদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে।
ট্রেনগুলো ৬ কোচ বিশিষ্ট ২৪ সেট। তবে ভবিষ্যতে ৮ কোচে উন্নীত করা যাবে। কোচের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা, মাঝের ৪টি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন এবং ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনের সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ২৩০৮ জন।
মেট্রোরেলের ডিপো : এমআরটি লাইন ৬-এর ডিপো উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত। এই ডিপো এলাকায় ৫২টি কাঠামো ছাড়াও ওয়ার্কশপ, ওয়াশিং শেড ও স্টোরেজ রয়েছে। এই ডিপোয় ১৮টি ট্রেন রাখা যায়। মেট্রো ট্রেনগুলো ডিপোয় উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশন থেকে উত্তরে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের ওয়ার্কশপ হয়ে প্রবেশ করতে হয়।
ডিপোয় একটি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র আছে যেখান থেকে ভ্রমণরত ট্রেনে চালকের সাথে যোগাযোগ করা যায়। যোগাযোগ করতে এই কেন্দ্র নিয়ন্ত্রক রেলপথে বসানো রেডিও অ্যান্টেনা ব্যবহার করে। মেট্রো সেবা সম্পর্কে যেন যাত্রীরা সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে সেজন্য ডিপোতে একটি প্রদর্শন ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে উন্মুক্ত করা হয়।
মেট্রোরেলে স্টেশন : এমআরটি লাইন ৬ রেলপথের স্টেশনগুলোতে নিচ তলা ও তার উপরে দুটি স্তর রয়েছে। উপরের প্রথম স্তর তথা সমাগম স্তরে প্রবেশ করতে সিঁড়ি বা এলিভেটর ব্যবহার করতে হয়। এই স্তরে স্টেশন কর্মকর্তাদের দপ্তর, বিশ্রামাগার ও টিকেট কাউন্টার রয়েছে। সেই স্তরে অস্থায়ী টিকেট কাটার একটি ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথম স্তর থেকে স্বয়ংক্রিয় ভাড়া সংগ্রহ জোন হয়ে যাত্রীকে এস্কেলেটর বা এলিভেটর ব্যবহার করে দ্বিতীয় স্তরে আসতে হয়। এই শেষ স্তরে ট্রেনের প্লাটফর্ম অবস্থিত।
রেলপথের খরচ কুলাতে ডিএমসিএল উত্তরা সেন্টার মেট্রো স্টেশন ঘিরে একটি পরিবহন ভিত্তিক উন্নয়ন হাব নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ ৳৮৬৬ কোটি বিনিময়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উত্তরা মডেল টাউন (৩য় পর্ব)-এর ২৯ একর জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুযায়ী এরকম হাব রেলপথের অন্তর্গত সমস্ত স্টেশনের জন্য নির্মিত করা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন বিআরটিসি উত্তরা উত্তর ও আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনের যাত্রীদের পৌঁছানোর সুবিধার্থে বাস সেবা চালু রেখেছে। এর বাসগুলো উত্তরা উত্তর থেকে হাউজ বিল্ডিং এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করে। এছাড়া, বিআরটিসি ২৪ ও ২৫ নামে দুটি বাস সেবা চালু করেছে যেগুলো যথাক্রমে আগারগাঁও, মিরপুর ১০, খামারবাড়ি ও বিজয় সরণিতে থামবে। অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট ও ডিএমটিসিএল মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী সব স্টেশনে স্মার্ট ডেলিভারি লকার বসানো হবে।
বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল এমআরটি লাইন-৬ এর প্রতিটি স্টেশনে কনকোর্স লেভেল আছে। এ লেভেলে উঠার জন্য প্রতিটি স্টেশনে সিঁড়ি, লিফ্ট এবং এস্কেলেটর আছে। এই সিঁড়ি, লিফ্ট এবং এস্কেলেটর ব্যবহার করে শুধুমাত্র মেট্রো ট্রেন চলাচলের সময় কনকোর্স লেভেল দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়া যাবে। তবে পেইড জোন এলাকায় ও প্লাটফর্মে যাওয়া যাবে না। পথচারীগণ রাস্তা পারাপারের জন্য এই ব্যবস্থাকে ফুট ওভারব্রীজের অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
মেট্রোরেলের ভাড়া ও টিকেট : এমআরটি লাইন ৬-এর জন্য মেট্রোরেলের টিকেটের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা ও কিলোমিটার প্রতি ৫ টাকা ঠিক করা হয়েছে।
মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য ডিএমটিসিএল এর আওতায় দুই ধরনের টিকেট/কার্ড রয়েছে। এগুলো হল- একক যাত্রার টিকেট এবং এমআরটি পাস।
যে কোনো মেট্রোরেল স্টেশন এর নির্ধারিত টিকেট অফিস হতে নিবন্ধন ফর্মে তথ্য প্রদান করে ও নির্ধারিত প্রাথমিক মূল্য (৫০০ টাকা) পরিশোধ সাপেক্ষে এমআরটি কেনা যাবে। এই পাসের মেয়াদ ১০ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ বা টপআপ করা যায়।
ভাড়া ছাড়াও রাজস্ব আয়ের উদ্যোগ : বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ভাড়ার আয় হতে লাভজনকভাবে মেট্রোরেল পরিচালনা করা যায় না। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো মেট্রোরেল পরিচালনার পাশাপাশি মেট্রোরেলের আন্তঃলাইন সংযোগ স্টেশন, ডিপো ও প্রধান প্রধান স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ক্রমান্বয়ে কেনাকেটার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই বাস্তবতায় এমআরটি লাইন-৬ লাইনের উত্তরা সেন্টার মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন ভূমিতেও একই ধরনের কেনাকাটার কেন্দ্র গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে ২৮.৬১৭ একর ভূমি বরাদ্দ গ্রহণ করা হয়েছে।
বরাদ্দ ভূমির মূল্য বাবদ প্রায় ৮৬৫ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা রাজউক-কে পরিশোধ করা হয়েছে। রাজউকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক ধরণার পরিকল্পনাও প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তর কাজ করছে। মেট্রোর প্রতিটি লাইনের প্রধান প্রধান মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় সুবিধাজনক স্থানে ন্যূনতম ৪টি করে স্টেশন প্লাজা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মেট্রোরেল ৬ লাইনের উত্তরা উত্তর, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় স্টেশন প্লাজা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সংস্থার ভূমি হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্তির কার্যক্রম চলমান আছে। ইতোমধ্যে স্টেশন প্লাজাগুলোর নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। উত্তরা উত্তর ও কমলাপুর মেট্রোরেল টার্মিনাল স্টেশনে দীর্ঘ মেয়াদে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখারও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের সুযোগ-সুবিধা : সাধারণ ট্রেন সার্ভিসের চেয়ে মেট্রোরেলের ট্রেনে অধিকতর আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো—
মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহন : এমআরটি লাইন ৬ এর যাত্রী পরিবহণ ক্ষমতা ঘন্টায় ৬০ হাজার ও দৈনিক ৫ লক্ষ। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী এমআরটি লাইন 6 ব্যবহার করে নিয়মিত প্রায় ৮০ হাজার যাত্রী চলাচল করে। ডিএমটিসিএলের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৪ সালে এর দৈনিক যাত্রী পরিবহন ৪ লাখ ৮৩ হাজার জনে এসে দাঁড়াবে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সুবিধা : এমআরটি লাইন ৬-এ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য মেট্রো ট্রেনে এবং মেট্রো স্টেশনে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা সংযোজিত আছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রী যেন টিকেট কাউন্টার হতে সহজে টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সে জন্য অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় টিকেট বুথ রয়েছে।
একইভাবে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীগণ টিকেট ভেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেই টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের পেইড জোনে সহজে প্রবেশ এবং বাহিরে হুইল চেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রশস্ত স্বয়ংক্রিয় টিকেট রিডিং গেট রয়েছে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লিফ্টে সহজে উঠা-নামার সুবিধার্থে লিফ্টের অভ্যন্তরে ধরার হাতল, নিম্ন উচ্চতায় কন্ট্রোল প্যানেল ও নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আয়না রয়েছে। লিফ্টের কন্ট্রোল প্যানেলে ব্রেইল পদ্ধতির বোতাম রয়েছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে স্টেশনে উঠা-নামার জন্য লিফ্টের সম্মুখে ঢালু পথ বা র্যাম্প আছে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য প্লাটফর্মে বিশেষ সুবিধা সম্বলিত টয়লেট রয়েছে। মুক ও বধির যাত্রীগণ ডিজিটাল নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে মেট্রো স্টেশনে ও মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যাত্রীদের মেট্রো স্টেশনে চলাচলের জন্য ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধার্থে হলুদ রঙয়ের ট্যাকটাইল পথের ব্যবস্থা রাখা আছে।
টয়লেট, লিফ্ট ও অগ্রাধিকার আসন সহজে বোঝার জন্য প্লাটফর্ম ও মেট্রো ট্রেনে শনাক্তকারী চিহ্ন রয়েছে। স্টেশন এলাকায় এবং মেট্রো ট্রেনের অভ্যন্তরে অডিও এবং ভিজুয়াল ইনফরমেশন সিস্টেম আছে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে অন্যান্য যাত্রীদের ন্যায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যাত্রীগণও শোনা ও দেখার মাধ্যমে সহজে মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারছেন।
যাত্রীদের পদ স্খলনজনিত দুর্ঘটনা রোধে এবং হুইল চেয়ার ও ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধার্থে মেট্রো ট্রেনের কোচের ফ্লোর এবং স্টেশনের প্লাটফর্মের উপরিভাগ একই সমতলে রাখতে মেট্রো কোচের নিচে অত্যাধুনিক এয়ার ব্যাগ সাস্পেনশন সংযোজন করা হয়েছে। মেট্রো কোচের বহির্ভাগ এবং প্লাটফর্মের মধ্যে সবখানে এমনভাবে ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে যাত্রীরা নিরাপদে ও সহজে মেট্রো ট্রেনে উঠা-নামা করতে পারেন।
মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের সুবিধা : মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত নিশ্চিতে প্রতিটি মেট্রো ট্রেনের সামনে একটি স্বতন্ত্র নারী কোচ আছে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন নারী যাত্রী শিশুসহ যাতায়াত করতে পারেন। নারী যাত্রীগণ ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারেন। গর্ভবতী নারী যাত্রীগণের জন্য মেট্রোরেল স্টেশনে লিফটের ব্যবস্থা আছে এবং মেট্রো ট্রেনে আসন সংরক্ষিত আছে।
এতে করে নারী যাত্রীরা সহজে ও নিরাপদে কর্মক্ষেত্র ও প্রত্যাশিত স্থানে দ্রুততম সময়ে যাতায়াত করতে পারছেন। মেট্রোরেল স্টেশনসমূহে প্ল্যাটফর্মে নারী যাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে এবং এতে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনের সুবিধা সংযোজিত আছে।
মেট্রোরেল ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা : বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এজন্য সর্বাধুনিক সব স্বয়ংক্রিয় পরিচালন ব্যবস্থা সংযোজিত করা হয়েছে। মেট্রো ট্রেনে যাতায়াতকারী যাত্রীর নিরাপত্তায় বিশেষ ধরনের প্রবেশদ্বার ও আইপি ক্যামেরসহ সিটিটিভি ব্যবস্থা বসানো হয়েছে।
আপৎকালীন মেট্রোরেলের ভেতর থেকে বের হবার জন্য জরুরি বহির্গমন দরজা রাখা হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশন, রুট এ্যালাইমেন্ট ও মেট্রো ট্রেনে অনাকাঙ্খিত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীদের সুবিধায় সুদক্ষ কর্মীর পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলাদা বিশেষায়িত এমআরটি পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়েছে।
মেট্রোরেল ব্যবহারে জনসাধারণকে সচেতন করার উদ্যোগ : অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেল সম্পর্কে জনসাধারণকে সম্যক ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে এমআরটি লাইন 6-এর উত্তরা ডিপো এলাকায় মেট্রোরেল এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেন্টারে মেট্রো ট্রেনের মক-আপ, মূল মেট্রো ট্রেন সেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচলে সক্ষম দুই সেট মিনি মেট্রো ট্রেন, মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে মিল রেখে টিকেট অফিস মেশিন, টিকেট ভেন্ডিং মেশিন এবং স্মার্টকার্ড উপযোগী স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ এবং বহিরগমন গেইট স্থাপন করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের অভ্যন্তরে ও মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীগণের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় সম্বলিত এ্যানিমেটেড কার্টুন প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই বিষয়ে মেট্রোগার্ল স্কুলে যায় মেট্রোরেলে চড়ে শিরোনামে একটি কার্টুন পুস্তিকা মূদ্রণ করে দর্শনার্থীগণের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মেট্রোরেল : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। দেশের সম্পূর্ণ জিডিপিতে ঢাকার অবদান প্রায় ৩৬ শতাংশ। ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০ হাজার। ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ ৯ হাজার ২৫৫টি। এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ জুন ২০২৩ তারিখে ২০ লক্ষ ১৯ হাজার ৯৪১টিতে উন্নীত হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর সড়ক ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৬.১২ কিলোমিটার মাত্র। উভয়ের প্রভাবে ঢাকা মহানগরীতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং ক্রমাবনতি হচ্ছে। এই যানজট এবং এর ফলশ্রুত প্রভাবে বার্ষিক প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করছেন।
এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এমআরটি লাইন-৬ এর সম্পূর্ণ অংশ চালু হবার পর মেট্রোরেল পরিচালনা করার সময় দৈনিক ভ্রমণ ব্যয় বাবদ প্রায় আট কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা এবং যান চলাচলের ব্যয় বাবদ প্রায় এক কোটি ১৮ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয় করা অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
পরিবেশ উন্নয়নে মেট্রোরেল এর ভূমিকা :
মেট্রোরেলের বায়ু দূষণ রোধে ভূমিকা : গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ থেকে এমআরটি লাইন-৬ এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রো ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। মেট্রোরেল সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত বিধায় কোনো ধরণের জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে মেট্রোরেল দ্বারা বায়ু দূষণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেট্রোরেল অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করছে বিধায় ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এতে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানীর ব্যবহারও হ্রাস পাচ্ছে।
ফলে এমআরটি লাইন-৬ রুট এ্যালাইনমেন্ট অংশে বায়ুদূষণ কমে আসতে শুরু করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এমআরটি লাইন-৬ এর সম্পূর্ণ অংশ চালু হলে এই রুটে যানবাহনের সংখ্যা কমার মাধ্যমে বছরে ২ লাখ ২ হাজার ৭৬২ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পাবে। মেট্রোরেল বায়ু দুষণ হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
শব্দ ও কম্পন দূষণ রোধে মেট্রোরেলের ভূমিকা : শব্দ ও কম্পন দূষণ রোধে এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচে বিশেষ ধরনের কম্পন সহনশীল স্তর ব্যবহার করা হয়েছে। ভায়াডাক্টের উভয় পার্শ্বে শব্দ প্রতিবন্ধক দেয়াল স্থাপন করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মেট্রোরেলে শব্দ ও কম্পন দূষণ মাত্রা মানদণ্ড সীমার অনেক নিচে রয়েছে। সার্বিকভাবে শব্দ ও কম্পন দূষণে মেট্রোরেল কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না।
মেট্রোরেল নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা : সাভার হয়ে এমআরটি লাইন-৬ রেলপথটি সম্প্রসারণের শেষ বিন্দু আশুলিয়া করা হয়। ২০২৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিকী লাইন-৬-এর উত্তর-পশ্চিমে আশুলিয়া ও বাইপাইল হয়ে নবীনগর পর্যন্ত আরেকটি অংশ নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিশ্চিত করেন যে, মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের সম্প্রসারণের কাজ শেষ হওয়ার পরে উত্তরা উত্তর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ কাজ শুরু হবে। ডিএমটিসিএল ১ মে ২০২৩ তারিখে জানায় যে, তারা টঙ্গী পর্যন্ত লাইন সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার পরিকল্পনা করেছে।
নির্মাণকাজের অগ্রগতি : ২০২৪ সালের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রী চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ২০২৩ সালের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এবং ২০২৪ সালের মধ্যে কমলাপুর পর্যন্ত শেষ করার লক্ষমাত্রা নিয়ে দ্রুত কাজ এগিয়ে চলছে।
উপসংহার : অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের প্রথম এবং প্রধান শর্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। ২০২৪ সালের মধ্যে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি হবে একটি মাইলফলক। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের অর্থ আর সময়ের অপচয় বন্ধ হবে। যানজটমুক্তভাবে মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।