বাংলা রচনা : মাতৃভাষা দিবস
মাতৃভাষা দিবস অথবা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
[ সংকেত : ভূমিকা, ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা, আন্দোলনে-সংগ্রামে বাংলা ভাষা , আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাভাষার যাত্রা, বিশ্বজনীন বাংলা ভাষা, উপসংহার। ]
ভূমিকা : অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর এ স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি এখন বিশ্বসভায় গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত। ইউনেস্কোর দেয়া এ বিরল সম্মান বাঙালির যেমন শ্রেষ্ঠ অর্জন; তেমনি আমাদের মহান ভাষা শহীদদের আত্মদানের সুমহান স্বীকৃতি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ অনেক যুবক। আমাদের জাতিসত্তা নির্মাণে এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাষার জন্য সেদিন তাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন বলেই পূর্ব বাংলার বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তা ছিল জাতীয় গৌরবের বিষয়। ১৯৫৩ সাল থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত আমরা তাঁদের ত্যাগের স্মৃতিকে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছি। কিন্তু '০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সে অনন্য দিন যে দিনটি সারা পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে পালিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ গৌরবের অংশীদার এখন প্রতিটি বাঙালি। আমাদের মুখের ভাষা বাংলা এখন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব আসনে অভিষিক্ত।
ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে যে ঘটনা ঘটেছিল তা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কেই রক্তাক্ত করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে সেদিন বাঙালির হাতে যে নতুন শিকল পরানো হয় তার পরিণাম হ মারাত্মক। পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকেই এদেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা ফন্দি আঁটে কিভাবে এদেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়া যায়। এ অংশের মানুষকে বসে রাখার জন্য তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার নীল নকশা রচনা করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা দেন, 'Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan'. কিন্তু এদেশের ছাত্র-যুবকরা সে সমাবেশেই 'No. No, It can't be' ধ্বনি তুলে তাঁর সে উদ্ধতপূর্ণ ঘোষণার সমুচিত জবাব দেয়। প্রতিবাদের ভাষা এবং এর ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সরকার সকল প্রতিবাদকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের একপেশে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এদেশের মানুষ। এদেশের দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ।
আন্দোলনে-সংগ্রামে বাংলা ভাষা : একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিল হবে তা আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্যে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা আইন জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, যেমন করেই হোক তারা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করবেই। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আহূত হয় ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা। সভা শেষে তারা মিছিল বের করে। সেদিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধিকারের দাবি। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসেছিল সে সময়। ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি এগিয়ে যায় প্রাদেশিক ভবনের দিকে। মিছিলকে ছাত্রভঙ্গ করার জন্যে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ফলে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউর প্রমুখ দামাল ছেলেরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা লিখে যায় এক অনন্য ইতিহাস। তাঁদের নিঃসৃত রক্তে সেদিন লেখা হয়ে যায় পূর্ববাংলার অমোঘ ভাগ্যলিপি। তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার সম্মান লাভ করে। বাঙালির স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকে সেই দিন, সেই রাজপথ, সেই ফুলার রোড।