বাংলা রচনা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, শিক্ষার মূলভিত্তি, শিক্ষাই সম্পদ, শিক্ষার অবদান, শিক্ষাহীনতার কুফল, বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, শিক্ষা সুপ্তগুণের বিকাশ ঘটায়, উপসংহার। ]
ভূমিকা : বহু যুগের বহু শতাব্দীর সঞ্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে সার্থকভাবে প্রয়োগ করার নামই শিক্ষা। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা করতে হলে, শিক্ষার বড় প্রয়োজন। শিক্ষাই একজন মানুষকে 'মানুষ' হতে সাহায্য করে। যে মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, সে মানুষ এ রহস্যময় সুন্দর পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় স্বাদ এবং সৌন্দর্য থেকেও বঞ্চিত। সে আদিমকালে মানুষ ছিল অসহায়। কিন্তু বিবর্তনের ধারায় শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ জয় করে নিয়েছে, এ পৃথিবীকে। প্রাণিকূলের মধ্যে মানুষই একমাত্র শিক্ষিত, যার ফলে অন্যান্য প্রাণী মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই মানুষ হয়ে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে নি তারা অসহায়, নির্বোধ প্রাণীর মতোই। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও তারা মানবেতর প্রাণীর মতো জীবনযাপন করে।
শিক্ষার মূলভিত্তি : জ্ঞানের রুদ্ধ দুয়ারকে খুলে ফেলার জন্য শিক্ষার বিকল্প আর কিছু নেই। শিক্ষাই মানুষকে জ্ঞান সমুদ্রের সন্ধান দেখায়। চার্লস ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদে বলেছেন— মানুষ ছিল মেরুদণ্ডহীন নিচু শ্রেণীর প্রাণী। লক্ষ কোটি বছরের ঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে সে আজকের এ মেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে যে অমূল্য শক্তিটি কাজ করেছে, তা হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাহীন মানুষ তাই সে মেরুদণ্ডহীন আদিম জীবেরই নামান্তর। মানুষ প্রকৃতি থেকে মধুর এবং বিধুর অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে। এ অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে প্রয়োগের চেষ্টাই হচ্ছে শিক্ষার মূলভিত্তি। এ অভিজ্ঞতার প্রয়োগ-কৌশল যে জাতির যত বেশি, সে জাতি তত বেশি উন্নত, তত বেশি সফল।
শিক্ষাই সম্পদ : শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ আহরণ করে অমূল্য জ্ঞান। আর জ্ঞানের মত এরকম শ্রেষ্ঠ সম্পদ আর কিছু নেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোন কোন সভ্যজাতি এখনো পৃথিবীর মানুষের কাছে আদর্শ হয়ে আছে। প্রাচীন গ্রিকরা শিক্ষার মাধ্যমেই এক স্বর্ণ যুগের সূচনা করে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিক শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানের যে উন্মেষ ঘটিয়েছেন তা সভ্যতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। লেখা হয়ে আছে চৈনিক সভ্যতার কথা। স্পেনের মুসলমানরা জ্ঞান-বিদ্যার যে উৎকর্ষ ঘটিয়েছিল তা এখনো পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
কোন জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে সে জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা দরকার। অন্ধকারে আচ্ছন্ন জাতি সহজে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। আর সে মুক্তির পথ হচ্ছে শিক্ষা। এ উপমহাদেশের মানুষ অশিক্ষিত ছিল বলেই চত ইংরেজরা এখানে প্রায় দু'শো বছর রাজত্ব করতে পেরেছে। এ সত্যটি যখন এখানকার মানুষ অনুভব করলো, তখন তারা শিক্ষার দিকে মনযোগী হলো। অবশেষে ইংরেজদের ক্ষমতার ভিত কেঁপে গেল এবং তারা পাতাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলো।
শিক্ষার অবদান : শিক্ষার অবদানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। শিক্ষা দ্বারাই মানুষ গড়ে তুলছে নতুন নতুন সভ্যতা। শিক্ষার আশ্চর্য সাফল্য দ্বারা মানুষ মিটাচ্ছে— তার দৈনন্দিন অভাব। বিংশ শতাব্দীর এ যে নানান অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, এতো শিক্ষারই দান। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ পরকে করেছে আপন, দূরকে করেছে কাছে। এখন ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী। এখন আমরা মুহূর্তের মধ্যে অনেক দূরত্ব পাড়ি দিতে পারি, ঘরে বসেই জানতে পারি পৃথিবীর সব খবরাখবর। শিক্ষা যেমন চিন্তার মুক্তি ঘটায়, তেমনি শিক্ষালব্ধ জ্ঞান দিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করে থাকি। এমনকি অবসরেও শিক্ষা থেকে গ্রহণ করি, আমরা বিনোদনের বিচিত্র উপাদান। বলা যেতে পারে শিক্ষা ছাড়া সমাজ, জাতি অচল। প্রাগ্রসর চিন্তা চেতনায় শিক্ষাই আমাদেরকে দেয় নতুন পথের সন্ধান।
শিক্ষাহীনতার কুফল : প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। কোন অশিক্ষিত মানুষ অর্থজোরে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে সত্য, কিন্তু প্রকৃত সম্মান তিনি কখনো লাভ করতে পারেন না। শিক্ষাই সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যথার্থ মাপকাঠি। যে ব্যক্তি শিক্ষিত নয়, তার কাছ থেকে সমাজ তেমন কিছু আশা করতে পারে না। সমাজে সে অবহেলার পাত্র বলে বিবেচিত হয়। অশিক্ষিত লোক কখনো সচেতন হতে পারে না। দেশ ও বিদেশের সম্যক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সে থাকে অজ্ঞ। অশিক্ষিত ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে যেমন সচেতন নয়; অন্যের সম্পর্কেও তেমন অসচেতন। সে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মীয়, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব ক্ষেত্রেই থাকে অজ্ঞ। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত বলে তারা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে, এ কারণেই বৃদ্ধি পায় জনসংখ্যা, সমাজ হয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিজ্ঞানের ব্যবহার সম্পর্কে তারা থাকে অজ্ঞ, আর এ কারণে তাদের জীবনে আসে না তেমন পরিবর্তন। সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে এরা থাকে পেছনের সারিতে।
বৈজ্ঞানিক শিক্ষা : শিক্ষার চরম পরিণতি বিজ্ঞানে। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি অগ্রসর সভ্যতা ও সফলতার ক্ষেত্রে সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। জাতির উন্নতির মূলে রয়েছে শিক্ষা, তথা বৈজ্ঞানিক শিক্ষা। কার্যকরণের জ্ঞানই জীবের জীবন রক্ষার সহজ সুযোগ সৃষ্টি করে। শিক্ষা ঐ কার্যকরণের তথ্যের সাথে মানুষকে সুপরিচিত ও অভ্যস্ত করাতে পারে। মানুষের বাঁচার আদিম ও প্রধান উপকরণ অনু। বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত জাতিরা আজ অন্নের প্রাচুর্যে অধিক অগ্রসর। কৃষি গবেষণা আজ প্রতিটি জাতির জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষা সুপ্তগুণের বিকাশ ঘটায় : বিশাল প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জন্ম। এখানেই সে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। তার এ বেড়ে ওঠার পেছনে সাহায্য করে শিক্ষা। শিক্ষার সাহায্যেই সে তার সুপ্তগুণের বিকাশ ঘটায় এবং প্রকৃতির সব কিছুকে আস্তে আস্তে চিনে নেয়। প্রকৃতির অনেক কিছুই রহস্যাবৃত থাকে, মানুষ শিক্ষার সাহায্যে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে। এবং নতুন জিনিস আবিষ্কার করে। এ আবিষ্কারই জাতির সম্পদ, জাতির শক্তি, জাতির কল্যাণের আধার। আর এসব কিছুর মূলেই রয়েছে শিক্ষা।
উপসংহার : যুগে যুগে জাতির জীবনে নেমে আসে ক্রান্তিলগ্ন। এ ক্রান্তিলগ্ন থেকে উত্তরণের সঠিক পথ নির্দেশ করেন শিক্ষিত ব্যক্তিরা। শিক্ষিত ব্যক্তি এবং তার শিক্ষা কোন জাতির জন্য নির্দিষ্ট থাকে না। সমগ্র পৃথিবীর সব জাতির জন্য তা অমূল্য সম্পদ। তাই যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত দৃঢ় এবং ঋজু। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায়, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড ।