দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে জনসচেতনা সৃষ্টির জন্য একটি ভাষণ রচনা কর
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে জনসচেতনা সৃষ্টির জন্য একটি ভাষণ রচনা কর।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আয়োজিত সভার সম্মানিত সভাপতি, প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি এবং সম্মানিত সুধী মণ্ডলী আসসলামুআলাইকুম।
সমাজের রন্ধ্রে রন্দ্রে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াল কালো থাবায় বিপন্ন আজ মানব সভ্যতা। এ সর্বনামা সামাজিক ব্যাধির মরণ ছোবলে বর্তমান সমাজ জর্জরিত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বত্রই চলছে দুর্নীতি। দুর্নীতির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। তাই বিশেষজ্ঞরা দুর্নীতিকে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদের সবাইকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, এর জন্য দায়ী কারণ খুঁজতে হবে এবং তা মোকাবিলার উপায় উদ্ভাবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ভাইসব, দুর্নীতি একটি ব্যাপক ও জটিল প্রত্যয়। দুর্নীতির গতিপ্রকৃতি বহুমুখী এবং বিচিত্র বলে এর সংজ্ঞা নিরূপণ জটিল কাজ। দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। দুর্নীতির সাথে পেশা, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, পদবি প্রভৃতি অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো ঘুষ বা অনুগ্রহ দ্বারা জনকর্তব্য সম্পাদনে একাগ্রতার বিবৃতি বা ধ্বংস। নৈতিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নীতিবিচ্যুত হওয়া বা কোনো গুণ ও পবিত্রতার অবমাননাই হলো দুর্নীতি। আবার প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ। কিংবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কাউকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারী নিজের খেয়ালখুশিমতো সরকারি ক্ষমতা বা পদমর্যাদার অপব্যবহার করে বা টাকা-পয়সা এবং বস্তুগত ও অন্যবিধ উৎকোচাদির মাধ্যমে অন্যায় কোনো কাজ করে অথবা ন্যায়সঙ্গত কাজ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার এরূপ কার্যকলাপ দুর্নীতি ।
সুধীমণ্ডলী, বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এ কালো ব্যাধির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এমনই শক্তিশালী যে, দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ৮ হাজার মামলা ঝুলে আছে শুধু দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে দেশ ও দেশের জনগণ যে কি বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা নিচের পরিসংখ্যান থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে :
১. বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. সদরুল রেজার অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৮৫ – ১৯৮৬ অর্থবছরে ঘুষ, কর ফাঁকি, চোরাচালানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে দেশের ২৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
২. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে, বাংলাদেশে অবৈধ আয়ের পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ৩০-৩৪ ভাগ হবে।
৩. বিশ্বব্যাংক ১৯৯৫ সালের ‘সাহায্য স্মারক' প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মোট লেনদেনের শতকরা ৭ ভাগ ঘুষ দিতে হয়।
ভাইসব : পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি থাকলেও বাংলাদেশে এর প্রসার অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়াবহ। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। যেমন—
আর্থিক অসচ্ছলতা : আর্থিক অসচ্ছলতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। দারিদ্র্যের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ সমাজে স্বাভাবিক উপায়ে মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বন করছে, যার প্রভাবে সমাজে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে।
বেকারত্ব : বাংলাদেশে ভয়াবহ বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে। বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অনেকে অবৈধ উপায়ে এবং ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করে। আবার চাকরি পাওয়ার পর তারাও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে দুর্নীতি ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
দুর্নীতি দমনে সদিচ্ছার অভাব ; দুর্নীতি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য চাকুরিচ্যুত বা বিচারের সম্মুখীন করার জোরালো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। দুর্নীতিবাজদের সাথে শাসকগোষ্ঠীর গোপন আঁতাত থাকায় শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা যায়। দুর্নীতি দমনের প্রতি সরকারের এই শিথিলতার ফলে বাংলাদেশে দুর্নীতি দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।
ভাইসব, বাংলাদেশে ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতির প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার জন্য নিম্নলিখিত উপায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন : বাংলাদেশে সর্বস্তরের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সকল প্রাসঙ্গিক ইস্যু মূল্যায়ন এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্য দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ নাগরিকদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্স দুর্নীতি দমনের একটি বিশদ কর্মসূচি সুপারিশ করবে।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : দুর্নীতি প্রতিরোধের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এজন্য শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত আইনের অধীন পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট মামলা মোকদ্দমা বিচার নিষ্পত্তি করতে পারেন। একই সাথে দুর্নীতিবাজদেরকে আদালতে হাজির করার অধিকার এবং আদালতের রায় কার্যকর করার পূর্ণক্ষমতাও বিচার বিভাগকে দিতে হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : দুর্নীতি দমনের পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনোভাবেই যাতে শাস্তি এড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট আইনের কঠোর প্রয়োগ দুর্নীতির প্রবণতা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আইনের ফাঁক বা অস্পষ্টতার সুযোগে কেউ যাতে দুর্নীতি করতে বা দুর্নীতি করে শাস্তি এড়িয়ে যেতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন, সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিক ও সামাজিক চেতনা সৃষ্টি : দুর্নীতি দমনের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো মানুষের মাঝে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। কারণ নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। এজন্য পারিবারিক পর্যায় থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তর পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
সুধীমণ্ডলী দূর্নীতির বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকার আহবান পূণর্বার ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য শেষ করছি, খোদা হাফেজ।