প্রতিভা
প্রতিভার বিকাশ
প্রতিভা ও সাধনা
[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, প্রতিভার বৈশিষ্ট্য, প্রতিভার দৃষ্টান্ত, প্রতিভার অলৌকিকতা, প্রতিভা ও সাধনা, প্রতিভার লালন, উপসংহার। ]
ভূমিকা : জগতের যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন তা সম্ভব হয়েছে প্রতিভার কল্যাণে। মানব জীবনের সফলতার চাবিকাঠি প্রতিভার মধ্যে বিরাজ করে। যাদের মধ্যে প্রতিভা থাকে, তাদেরকে প্রতিভাবান বলে। বিশ্ব সভ্যতায় মানব জাতি বর্তমানে যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে সে অবস্থান প্রতিভাধরদের সৃষ্টি। মানুষ তার প্রতিভা দিয়েই বিশ্বকে শাসন করছে। ভূলোক ও দ্যুলোকে মানুষ তার বিজয় পতাকা উড়িয়েছে প্রতিভার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতিভার যাদুস্পর্শে যে কোন পরিস্থিতি হয়ে ওঠে সহজ, সরল ও কল্যাণকর। এভাবেই প্রতিভাধর ব্যক্তিরা মানব সভ্যতার বিবর্তনে যেমন অবদান রাখতে পেরেছেন, তেমনি সম্মানেরও অধিকারী হয়েছেন।
প্রতিভার প্রয়োজনীয়তা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে বিবেক, বুদ্ধি দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। এই বুদ্ধি বা প্রতিভার বলেই মানুষ আদিম অবস্থাথেকে আজকের সভ্যতায় উন্নীত হয়েছে। তবে সকল মানুষেই সমান প্রতিভার অধিকারী নয়। কেউ কেউ পরিবারিক বা বংশানুক্রমিক ভাবে অধিক প্রতিভার অধিকারী হয়। আবার কেউ কেউ প্রকৃতিগত ভাবেই কম প্রতিভার অধিকারী হয়। বাস্তবিক জীবনে প্রতিভার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ জগৎ প্রতিযোগিতাশীল। মানুষকে অনেক বড় বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সামান্য বুদ্ধির ভুলে মানুষকে অনেক বড় খেসারত দিতে হয়। প্রতিভার বলেই মানুষ শূন্য থেকে সাফল্যের শীর্ষে উঠে যেতে পারে। জগতে এমন উদাহরণ রয়েছে অসংখ্যা। তা না হলে সামান্য ঝাড়ুদার থেকে আমেরিকার মত দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। এজন্য তাকে প্রতিভার পরিচয় দিতে হয়েছে। প্রতিভার বলেই হাবলি গোলাম থেকে রাজ্যের হওয়া যায়। আর প্রতিভার অভাব থাকলে অথবা প্রতিভাকে কাজে লাগাতে না পারলে অনেক উপরে থেকে নিচে নেমে আসতে হয়। প্রতিভার অভাবে অনেক সম্পদশালী সম্পদ কে কাজে লাগাতে পারে নি। এক সময় তার সকল সম্পদ শেষ হয়ে সেম পথের ভিখারীতে পরিণত হয়েছে। তবে প্রতিভার পরিচর্যার মাধ্যমে জীবনে সফলতা লাভ করা যায়।
প্রতিভার বৈশিষ্ট্য : প্রতিভা মানব জীবনের অন্যতম গুণ। পৃথিবীতে সৃষ্ট জীবগুলোর মধ্যে একমাত্র মানুষই প্রতিভার অধিকারী। প্রতিভা এমন একটি গুণ যার সাহায্যে অনেক অসম্ভব কাজকে সম্ভব করা যায়। প্রতিভাকে বিধাতার অলৌকিক দান বলে মনে করা হয়ে থাকে। মানব জীবনে সফলতার মূলে রয়েছে প্রতিভা। প্রতিভার কল্যাণেই সব কাজে আসে আশানুরূপ সাফল্য। সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে অনেকেই প্রতিভাকে বিধাতার অপরিসীম দান বলে মনে করে। এজন্য প্রতিভার স্পর্শে যে সাফল্য আসে তার মধ্যে অনেকে অলৌকিকতার সন্ধান পান। জীবনের চলার পথের অনেক কঠিন পথও প্রতিভার কল্যাণে হয়ে উঠে সহজতর। যে কোনো মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো বিষয়ে প্ৰতিভা থাকে। শিশুদের মধ্যে সহজাত প্রতিভার বৈশিষ্ট্য নিহিত। কোন কোন মানুষ তার প্রতিভার পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারে, আবার কোন কোন মানুষ পারে না। আবার কেউ কেউ প্রতিভার যৎসামান্য ব্যবহারের মধ্যেও সফলতার শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছতে পারেন। যাদের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে, তাদেরকে ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিভার কল্যাণে কোন মানুষ সামাজিক জীবনে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
প্রতিভার দৃষ্টান্ত : আজকের পৃথিবী হাজার হাজার বছর পূর্বে এ রকম ছিল না। প্রতিভাশালীদের যাদুময়ী হাতের ছোঁয়ায় মানব সভ্যতা বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। হযরত মুহাম্মদ (স), যিশু খ্রিস্ট, গৌতমবুদ্ধ প্রমুখ প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের অবদানের কথা শেষ করা যাবে না। তারা ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। এরা সবাই মানবের জয়গান রচনা করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অসাধারণ প্রতিভার দলিল ছিল 'মদিনা সনদ'। এ সনদই ছিল প্রথম লিখিত সনদ। ‘মদিনা সনদে’ আমরা তাঁর অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষাৎ পাই। বর্তমান যুগকে বিজ্ঞানের যুগ বলা হয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুফল ভোগের মাধ্যমে মানুষ হয়ে উঠেছে আধুনিক। যারা এগুলোর আবিষ্কারক তারা সবাই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। এদের মধ্যে এইকেন, চার্লস ব্যাবেজ, এডিসন, বেয়ার্ড, আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল, গ্যালিলিও, এস ফ্যারাডে, আলফ্রেড বি নোবেল, জেমস ওয়াট আর্কিমিডিস, আইনস্টাইন, নিউটন, রাদারফোর্ড প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো প্রমুখ প্রতিভাশালীদের অবদানের কথা বলে শেষ করা যায় না। তারা বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান রেখে গিয়েছেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
প্রতিভার অলৌকিকতা : প্রতিভা বিধাতার অশেষ দান বলে মনে করা হয়। আমরা মনে করি প্রতিভার মধ্যে অলৌকিকতা রয়েছে। এ অলৌকিকতার কল্যাণেই তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। তাঁরা প্রভাবশালী মানুষ হিসেবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন। তাদের নিজেদের মনে প্রতিভা সম্পর্কে কি ধারণা তা তলিয়ে না দেখে মানুষ বাইরে থেকে অলৌকিকতা আরোপ করে। আসলে প্রতিভা অলৌকিক কিছু নয়। প্রতিভার মধ্যে অলৌকিকতা থাকতে পারে, তবে তা যৎসামান্য। ভলটেয়ার বলেছেন, “প্রতিভা বলে কোন জিনিস নেই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর, প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।” প্রতিভা সম্পর্কে এডিসন বলেছেন, “প্রতিভা একভাগ প্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ কঠিন পরিশ্রম।” জীবনের সফলতা নির্ভর করে পরিশ্রম ও সাধনার ওপর। সফলতার ক্ষেত্রে অলৌকিকতা আরোপ করা অনেকে সমীচীন মনে করেন না। বিধাতা কারও ওপর অলৌকিকভাবে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। মানুষকে পরিশ্রমের মাধ্যমেই সব কিছু অর্জন করতে হয়।
প্রতিভা ও সাধনা : জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হয়। প্রতিভা ও সাধনার সংমিশ্রণে কোন কাজে সফল হওয়া যায়। কোন কোন মানুষের মধ্যে প্রতিভা বেশি থাকতে পারে ঠিকই, তাই বলে সাধনা ছাড়া সেই প্রতিভার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। কেউ যদি মনে করে, আমার মধ্যে প্রতিভার কমতি নেই, আপনা আপনিই আমার জীবনে সফলতা আসবে। তাহলে সে কখনো সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে না। প্রতিভাকে সাধনার মাধ্যমে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়। সাধনার মাধ্যমে নিজের কর্মস্পৃহা পরিচালনা করতে পারলে মানুষ সাফল্য অর্জন করতে পারে। সাধনার দ্বারাই জীবনের যাবতীয় বাধা-বিপত্তি দূর করা সম্ভব। মানুষ যদি চেষ্টা করে, তাহলে সে সফল হবেই। বিশ্বে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে নিরন্তর সাধনা দ্বারা জীবনকে সার্থক করা সম্ভবপর হয়েছে। বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের দিকে দৃষ্টি রাখলে আমরা বুঝতে পারি, কত সাধনা দ্বারাই আবিষ্কারকেরা সফলতা লাভ করেছে। মানুষের সখ হলো আকাশে উড়বে। মানুষ শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। মানুষ যেদিন আকাশে উড়তে সক্ষম হলো— সেদিন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। বিজ্ঞানের অন্যান্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম আর সাধনা। প্রতিভার সাথে সাধনার সংমিশ্রণই কোন ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনে। বিধাতা প্রতিভা দেননি তাই জীবনে কোন কিছু অর্জন করতে পারলাম না –এমন ধারণা পোষণ না করে যথার্থ সাধনা দ্বারাই সফলতা অর্জন সম্ভব। এ কারণেই পরিশ্রমী মানুষ প্রতিভার কথা মনে না রেখে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে চলে এবং পরিণামে সুখ ভোগ করতে সমর্থ হয়। জীবনের সাফল্যের জন্য অবশ্যই নিরলস সাধনা করা জরুরি।
প্রতিভার লালন : যে কোনো কিছুই লালনের অভাবে নষ্ট হতে বাধ্য। যত্ন না করলে সবকিছুই তার প্রকৃত অবস্থা হারায়। প্রতিভাকে যথাযথভাবে লালন না করলে, তা একদিন নষ্ট হয়ে যায়। ড্রাইডেন বলেছেন, ‘প্রতিভা তৈরি করা সম্ভব নয়, প্রতিভা জন্য নেয়।' তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে, যত্ন না করলে রত্ন মেলে না। প্রতিটি মানুষের মধ্যে প্রতিভা থাকে। লালনের মাধ্যমে প্রতিভা বিকশিত হয়। পৃথিবীতে যারা স্বীয় কর্মের গুণে বিখ্যাত হয়ে আছেন, তারা সবাই প্রতিভার চর্চা করেছেন। বিখ্যাত মনীষী অ্যারিস্টটল সাহিত্য, দর্শন, ধর্মনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি যদি প্রতিভার লালন না করতেন, তাহলে সফল হতে পারতেন না। অনেক প্রতিভা যত্নের অভাবে অকালে ঝরে যায়। অথচ সঠিক পরিচর্যা পেলে তারাই হতে পারত বিখ্যাত কোন ব্যক্তি। প্রতিভার প্রয়োজনীয় যত্ন বা লালন করতে পারলে তার সুফল পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমরা যদি প্রতিভাকে বিধাতার দান বলেও মনে করি, তবুও তার যত্ন করা দরকার। কাজেই, প্রতিভার যথার্থ লালনের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়নে যে কোনো কাজ করতে হবে। নিজের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি অন্যের প্রতিভা বিকাশেও অবদান রাখতে হবে।
প্রতিভার মূল্যায়ন : যারা প্রতিভাবান তারা সমাজের অথবা রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই সফলতা লাভ করে। প্রতিভাবান মানুষ - দেশ ও জাতির সম্পদ স্বরূপ। প্রতিভাবানদের কদর সর্বত্রই রয়েছে। যারা প্রতিভাবান কোন জায়গায়ই তারা ব্যর্থ হয় না। চাকরীর ক্ষেত্রে প্রতিভাবানদের মূল্যায়ন বেশি করা হয়। কারণ প্রতিভাবানদের দ্বারা ভঅল ফল আশা করা যায়। তাছাড়া যারা ব্যতিক্রম প্রতিভার অধিকারী তারা নানা কল্যানমূলক আবিষ্কারের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে উন্নয়তের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে দেশ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত হয়। সে সকল প্রতিভাবান মানুষের কদর দেশের গণ্ডি পেরিযে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হয়। যে দেশের মানুষ প্রতিভার মূল্যায়ন করে না তারা পশ্চাৎপদ।
উপসংহার : প্রতিভা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এতে কোনো সন্দেই নেই। প্রতিভার গুণেই মানুষ বিশ্বকে শাসন করছে। প্রতিভার যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আধুনিক সভ্যতার সুফল ভোগ করছি। প্রতিভাশালী ব্যক্তিবর্গের অবদানে পৃথিবী আজ সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। আগামী দিনে পৃথিবীতে বেরিয়ে আসবে নব নব প্রতিভা যা মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখবে। প্রতিভার লালন করা আবশ্যক। নিজের প্রতিভা লালনের পাশাপাশি যাদের মধ্যে প্রতিভার লক্ষণ দেখা যায়, তাদের যথার্থ লালন করে বৃহত্তর কল্যাণে লাগাতে হবে। প্রতিভা যাতে অকল্যাণে ব্যবহৃত না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। বিকাশের ক্ষেত্র না পেলে প্রতিভা ক্রমশ বিনষ্ট হয়ে যায়। কাজেই, প্রতিভা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।