বাংলা রচনা : বাংলাদেশের নকশি কাঁথা

বাংলাদেশের নকশি কাঁথা

বাংলাদেশের নকশি কাঁথা

রচনা সংকেত : ভূমিকা, বিবরণ, উপসংহার।

ভূমিকা : যে কোন জাতি অতীতকালের তৈরি অনেক সৃষ্টি নিয়ে গর্ব করে থাকে। অতীতের এ ধরনের কীর্তির মধ্যে প্রতিফলিত হয় জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাংলাদেশেরও ঐতিহ্য আছে—বর্ণময় গৌরবময় ঐতিহ্য। শিল্পকলার ক্ষেত্রে এমন একটি ঐতিহ্য হচ্ছে নকশি কাঁথা।

বাংলাদেশের নকশি কাঁথা এমনই সুন্দর যে শুধু দেশেরই নয়, বিদেশের লোকেরাও বাংলাদেশের নকশি কাঁথার রূপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি।

বর্ণনা : কাঁথা কি দিয়ে তৈরি করা হয়? এ বিষয়ে কবি জসীমউদ্দীন খুব সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, "সাধারণ পুরাতন কাপড়ের পাড় হতে সুতো তুলে অথবা হাট হতে তাঁতীদের কাছ থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতো কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে সুতো এক কণা জড়িয়ে এক একটি গুচ্ছ সুতো পাক দেয়া হয়। পাক দেয়া হলে তাদের এক একটি আঙ্গুলের মধ্যে আটকিয়ে দুটো পাক দেয়া সুতো একত্র করে উল্টো পাক দেয়া হয়। এভাবে সুতো তৈরি হলে তাদের হাতের কব্জিতে জড়িয়ে আবার পাকিয়ে রাখা হয়। কাঁথা সেলাইয়ের সময় সেগুলোকে ইচ্ছেমত কাজে লাগানো যায়।"

কাঁথা সেলাই করতে হলে— প্রথমেই দরকার পুরনো ছেঁড়া কাপড়-চোপড়ের, এরপর লাগে নানা রঙ্গের সুতো। কিভাবে সুতো পুরনো শাড়ির পাড় থেকে সংগ্রহ করতে হয়, সেটা আমাদের দেশের মা-বোনেরা খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু ছেঁড়া বা পুরনো কাপড়-চোপড় এবং রঙিন সুতো পেলেই কি আর কেউ তৈরি করতে পারে? ছেঁড়া বা পুরানো কাপড়কে প্রথমে পাট করে বিছিয়ে নিতে হয়।

কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন—

“কাঁথা সেলাই করতে হলে প্রথমে কতগুলো ফোঁড় শিক্ষা করতে হয়। এ ফোঁড়গুলো কাঁথায় নকশায় চিত্রণের কাজ করে। বরকা ফোঁড়, তেরসী ফোঁড়, বাঁশপাতা ফোঁড় আরো অনেক রকমের ফোঁড় কাঁথা ব্যবহৃত হয়। ”

কাঁথা সেলাই করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের গ্রামের মা-বোনেরা দিনের পর দিন কষ্ট করে কাঁথা সেলাই করা শিখতেন। দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় এ বিষয়ে মত দিতে গিয়ে বলেছেন— “কন্যা জন্মিলে মাতা একখানি কাঁথা সেলাই করিতে আরম্ভ করিতেন— খুকুমনির বরের সেই একখানি কাঁথা সমাধা করিতেন, তখন বর তাহা পাইতেন।” বাংলাদেশে এরকম উদাহরণও আছে যে, দাদী-নানী যে কাঁথার সেলাই শুরু করতেন, সে কাঁথার সেলাই শেষ হতো নাত- বৌয়ের হাতে। একখানি কাঁথা তৈরি করতে বছরের পর বছর কেটে যেত। এসব কাঁথা আর সাধারণ কাঁথা নয়। এগুলো হলো গাঁয়ের মা-বোনদের শিল্পকলা। তাঁদের মনের মধ্যে সুন্দরের যে রূপ লুকিয়ে থাকে, তাই দেখা যাবে কাঁথার শিল্পের মধ্যে।

সাধারণভাবে ভাগ করলে আমরা কাঁথাকে কয়েক ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন- বিছানার জন্য কাঁথা, গায়ে দিতে শীত নিবারণের কাঁথা, পূজোর জন্য আসন, জায়নামাজ, গাঁঠরি এবং বালিশের ঢাকনিতে শিল্পকর্ম থাকে বেশি। কারণ, এগুলোতে সূঁচের কাজ করার জায়গা থাকে বেশি। রঙিন সুতো দিয়ে দিনের পর দিন মনের মতো ছবি আঁকে মেয়েরা।

গাঁয়ে আমাদের মা-বোনেরা দু চোখে যা দেখেন তারই ছবি আঁকে কাঁথায়। বাড়ির আশে পাশেই গাছপালা, ফুল, পাখি, জন্তু-জানোয়ার, বাড়ি-ঘর, হাতা, থলে, যাতি, ঘড়ি, অলঙ্কার এসবের ছবিও আছে কাঁথায় আর আছে দোলায়িত লতাপাতা ও দোলায়িত রেখার কারুকাজ। কাঁথায় মসজিদ ও মন্দিরের চিত্রও আছে। কাঁথায় এসব ছাড়াও প্রাচীন কিছু কিছু জিনিস দেখা যায়। যেমন ভোরের সূর্য, চাকা, পদ্ম, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত প্রভৃতি। অবশ্য কোন কাঁথাটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করে কাঁথা কত মোটা কত লম্বা বা প্রস্থে কত বড় হবে বা কাঁথা কত ছোট হবে তারই ওপর।

কাঁথাকে বলা হয় লোকশিল্প। লোকশিল্প কি? আমাদের গাঁয়ের মা বোনেরা লেখাপড়া জানেন না। আর জানলেও তাঁরা তো আর স্কুলে পড়েননি। স্কুলে লেখাপড়া শিখে বা আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখে তাঁরা কাঁথায় কাজ করেন না। তাঁরা দাদা- দাদী, খালা-ফুফুর কাছে যা শিখেন, সেটাই আবার নিজেদের মেয়েদেরকে শিখিয়ে দিয়ে যান। এভাবেই লোকশিল্পের কাজ যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে। শহরের মা বোনেরাও কাঁথা সেলাই করে থাকেন। কিন্তু তা হচ্ছে আধুনিক জীবন শিল্পের কাজ। গাঁয়ের কাঁথায় এ আধুনিকতা নেই। আর এ কারণেই কাঁথাকে বলা হয় লোকশিল্প বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী কামরুল হাসান কি সুন্দর করে বলেছেন এ কাঁথার কথা— তখনকার দিনের মা, বোন, খালা, চাচী, ফুফুরা সংসারের কাজ সাঙ্গ করে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে পাটি বিছিয়ে পানের বাটাটি পাশে নিয়ে পা মেলে বসতেন, কাঁথা সেলাই করতে। পাড়া-পড়শীরাও আসত গল্প করতে। এমনি এক একটি কাঁথা সেলাই, কত গল্প, হাসি, কত কান্নার মধ্যে দিয়ে শেষ হতো তা বলা যায় না। শুধু কতগুলো সূক্ষ্ম সেলাই আর রঙ-বেরঙের নকশার জন্যই নকশী কাঁথা বলা হয় না। বরং কাঁথার প্রতিটি সুচের ফোঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক একটি পরিবারের কাহিনী, তাদের পরিবেশ, তাদের জীবন-গাঁথা, এজন্য এগুলোকে বলা যেতে পারে নকশী কাঁথা।

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ঋতু পরিক্রমায় গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষাকাল। বর্ষাকালে চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। গ্রামগঞ্জের প্রায় সকল এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়। মাঠঘাটের ফসল ডুবে যায়। এ সময় গ্রামের কৃষকদের যেমন কাজ থাকে না, ঠিক তেমনি কৃষক বধূদেরও কাজ কমে যায়। এসময়ই তারা মূলত নকশি কাঁথার কাজ করে থাকে। একটি কাঁথা তৈরি করতে প্রায় দুমাস সময় লেগে যায়।

নকশি কাঁথা আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যের এক অনন্য স্মারক। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। তাছাড়া যান্ত্রিক জীবনে মানুষ নকশি কাঁথার মতো সৌখিন জিনিস তৈরি করার সময় পায় না। যে কারণে নকশি কাঁথা এখন অনেকটা জাদুঘরের বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। উপযুক্ত কারিগর না হলেও নকশি কাঁথা অতটা সুন্দর হয় না। মূলত নকশি কাঁথা একটি উঁচু মানের শিল্প। এ শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া প্রয়োজন। তবে একদিকে যেমন আমাদের প্রায় বিলুপ্ত ঐতিহ্য রক্ষা পাবে ঠিক তেমনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

নকশি কাঁথার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। নকশি কাঁথা তৈরি করে একটি পরিবার ভালোভাবে তার সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে পারে। আধুনিক যান্ত্রিক যুগ হলেও মানুষ নকশি কাঁথার প্রতি এতটুকু আগ্রহ হারায়নি। বরং বেশি দাম দিয়ে নকশি কাঁথা কেনার মতো অনেক মানুষ রয়েছে। শুধু তাই নয় সম্ভব হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে নকশিকাঁথা বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে নকশি কাঁথার বাস্তবতা একটু ভিন্ন। মানুষ একদিকে যেমন কম সময়ে যেকোন কাজ করতে চায় অনুরূপভাবে কম খরচে কাজ সারতে চায়। আর তাই নকশি কাঁথা তৈরি থেকে মানুষ একটু দূর সরে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী বিলাসী শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সচেতন মহলের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

উপসংহার : বাংলাদেশের নকশী কাঁথা ও অন্যান্য লোকশিল্প সম্পর্কে প্রথম লিখেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন ও গুরুসদয় দত্ত। এঁরা বাংলাদেশের কাঁথা ও অন্যান্য লোকশিল্প সংগ্রহও করেছিলেন। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম এবং চব্বিশ পরগনায় গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালায় আমাদের কাঁথার সংগ্রহ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের কাঁথার সংগ্রহ দেখবার মতো। শিল্পী কামরুল হাসানও লোকশিল্প সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলা একাডেমীর সংগ্রহ শালাতেও রয়েছে নকশি কাঁথা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের চেষ্টায় সোনার গাঁয়ে লোকশিল্পের একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সেটা এখনো সম্পূর্ণ গড়ে উঠেনি, তবু আশা করা যায়, সেখানেই তার সংগৃহীত অমূল্য কাঁথাগুলো স্থান পাবে। বিলাতের এলবার্ট মিউজিয়াম এবং আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের কাঁথার বিশাল সংগ্রহ রয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url