অভিজ্ঞতা বর্ণনা : লালন শাহের আখড়ায় একদিন

লালন শাহের আখড়ায় একদিন

লালন শাহের আখড়ায় একদিন

খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখি, ইটের ভাঁটায় চোঙ্গার মুখে ধোঁয়া উড়ছে— মনে হচ্ছে যেন বিরাট এক দৈত্য চিত হয়ে শুয়ে আয়েশ করে চুরুট টানছে! তাড়া খুব । আমি দ্বিচক্র যানখানি দ্রুত চালিয়ে নিয়ে ছুটছি কলেজের উদ্দেশে । সাতটার আগে পৌঁছতেই হবে, নইলে ট্যুরের বাস ধরা যাবে না । আমরা বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষ মহোদয়কে অনুরোধ করে কলেজ থেকে একদিনের ট্যুরে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছি । উদ্দেশ্য কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে বাউল সাধক লালন শাহ্র আখড়া দর্শন এবং বাউল দর্শনের ওপর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ । বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে গিয়ে আমি আমার নির্ধারিত সিট দখল করলাম ।

বাস চলছে ঝড়ের বেগে । জানুয়ারির মাঝামাঝি । সড়কের দুই পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পেঁয়াজের ফুল ফুটে একশা । বাসের জানালা দিয়ে এ রকম আরও অনেক ফসলের সমাহার দেখতে দেখতে আমরা আমাদের গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছলাম । আমাদের পৌঁছতে বেলা দেড়টা বেজে গেল । গাড়িতে অবশ্য নাশতা সেরে নিয়েছি । পৌঁছেই পুরো আখড়াটি একবার চক্কর দিলাম । এটা ২০০৯ সালের কথা । লালন কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ তখনও চলছে । আমরা লাঞ্চ সেরে মূল আস্তানায় প্রবেশ করলাম । আখড়ার প্রবেশ মুখেই মরমি সাধক লালন শাহের সমাধি চোখে পড়ল । আমি তাঁর সমাধির পাশে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমার ভেতর তখন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি বিরাজ করছিল । পাশেই আরও কয়েকজন শিষ্যের সমাধি, তার মধ্যে সাইজীর পাদদেশে তাঁর বিশেষ শিষ্য বিশখা ফকিরানির সমাধি দর্শন করলাম । সর্বত্রই সেখানে দর্শনার্থীদের সমাগম হয় এবং বাউলদের দলগত সংগীত সাধন ও তত্ত্বীয় আলোচনা চলতে থাকে । আমি কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ বাউলদের সাথে ফকির লালন শাহ্ এবং তাঁর বাউল দর্শন নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেলাম। সত্যিই সাধকের সান্নিধ্য মনে-প্রাণে এক অন্য রকম আবহের সৃষ্টি করে । আমি তাদের বিদগ্ধ আলোচনা থেকে যা অবগত হলাম তা হলো :

ফকির লালন শাহ্ (১৭৭২-১৮৯০) ছিলেন বিখ্যাত বাউলসাধক ও মরমি কবি । কিংবদন্তি আছে— এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম । যৌবনে তিনি তীর্থযাত্রীদের সঙ্গী হয়ে গঙ্গাস্নানে যাত্রা করেন । পথিমধ্যে বসন্ত রোগাক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে যায় । সেখান থেকে সিরাজ শাহ্ নামক জনৈক মুসলমান বাউলসাধক তাঁকে কুড়িয়ে নেন এবং শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন । অতঃপর সিরাজ শাহের আশ্রয়েই তিনি থাকেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মরমি সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন । গুরু সিরাজ শাহের মৃত্যুর পর লালন কুষ্টিয়ায় গমন করেন এবং কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়া গ্রামে একটি আখড়া তৈরি করেন । সেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন । লালনের শিষ্যরা তাঁকে সাইজি বলে সম্বোধন করত। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি মহোৎসবের আয়োজন করতেন; যাতে সহস্রাধিক শিষ্য একত্র হতো এবং সেখানে সংগীত ও দেহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হতো । শোনা যায় লালনের শিষ্যের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি ছিল । বস্তুত বাউল একটি বিশেষ ধর্মমত। এক্ষেত্রে লালনকে বাউল মত ও বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে । কেননা বাউল দর্শন সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে । বাউল সংগীত মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত, বিশেষ এক বাণী ও সুর । বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং তারা উদার ও সম্প্রদায়নিরপেক্ষ ধর্মসাধক । তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন । বাউল মতবাদের মাঝে বৈষ্ণবধর্ম এবং সুফিবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষত বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন আত্মাকে । তাদের মতে, আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায় । আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন । নিরক্ষর হলেও বাউলেরা জীবন দর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন । মোটকথা, বাউল গানের মধ্য দিয়েই তারা তাদের দর্শন ও মতামত প্রকাশ করে থাকেন ।

কুষ্টিয়ার আখড়ায়ই মূলত লালনের প্রতিভার ও সাধনার পূর্ণ বিকাশ ঘটে । প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালাভ না করলেও তিনি নিজের সাধনায় হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন । বাউলসাধক ও বাউল সংগীত রচয়িতাদের মধ্যে তাঁর স্থান শীর্ষে । তাঁর গান অধ্যাত্মভাব, মরমি রসব্যঞ্জনা ও শিল্পীগুণে সমৃদ্ধ । তাঁর রচিত গানের সংখ্যা সহস্রাধিক । তার মধ্যে— খাঁচার ভেতর অচিন পাখি', 'বাড়ির কাছে আরশি নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে,’ ‘নানা বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ' ইত্যাদি গান বাউল তত্ত্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ । এত অল্প সময়ে কিই বা জানা যায় । তবু যথা সম্ভব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং আখড়ার কিছু ছবি তুলে ফেরার জন্য সবাই বাসে উঠে পড়লাম । কলেজে পৌঁছতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেল । সেখান থেকে পুনরায় দ্বিচক্রযানখানি চেপে বাড়ির লক্ষে ছুটলাম । আকাশে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ কুয়াশা ভেদ করে আবছা জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছিল । জ্যোৎস্না মাখা কুয়াশা ভেঙে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ভ্রমণশ্রান্ত অবসন্ন শরীরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url