পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক আলোচনাচক্রে প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর

পড়ার অভ্যাস গঠন বিষয়ক আলোচনাচক্রে প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর

'পড়ার অভ্যাস গঠন' বিষয়ক আলোচনাচক্রে প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর ।

আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী, প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রী ও উপস্থিত সুধীজন— আপনাদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ।

মানুষকে অবশ্যই জ্ঞানী, বিবেচক ও রুচিসম্পন্ন হতে হয় । শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনও করতে হয় । তাছাড়া মানুষের যথার্থ শ্রেষ্ঠত্ব পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয় না । এজন্য প্রয়োজন বই পড়া, জ্ঞানার্জন করা তথা পড়ার অভ্যাস গঠন করা ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
'মানুষের জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আছে । তা হচ্ছে— বই, বই, বই ।' প্রখ্যাত লেখক টলস্টয়ের এই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করছি । মানুষকে যেমন সুন্দর ও মানানসই পোশাক পরতে হয় তেমনি চিত্তকে সুন্দর করতে হলে অবশ্যই বই পাঠের প্রয়োজন হয় । বই পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে যে গভীর চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীলতা জন্ম নেয়— তাই এ বিশ্বকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপলব্ধির সক্ষমতা সৃষ্টি করে । ফলে বই পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম ।

সম্মানিত সুধী
আমরা প্রায় সকলেই জানি, আল্লাহতায়ালা যখন মহানবিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন তখন তাঁর প্রথম শিক্ষাটাই ছিল— ‘ইকরা' অর্থাৎ পড় । সত্যিই পড়াশুনা ছাড়া কারও উপলব্ধির জগৎ উন্মোচিত হয় না ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
পাঠাভ্যাসের অনেক নজির আমরা পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোকের কাছ থেকেই পেয়েছি । বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রেলওয়ের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বই পড়তেন । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অসংখ্য বই-পুস্তক পাঠ করেই তো বিশ্বসভায় স্থান করে নিয়েছেন । বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম যুদ্ধ-হাঙ্গামা আর প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যেও পড়েছেন অসংখ্য আরবি, ফারসি গ্রন্থসহ অন্যান্য অনেক বই । এছাড়াও বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে একটা গল্পও তৈরি হয়েছিল যে— তিনি গ্রন্থাগারে বই পাঠে এত নিমগ্ন ছিলেন যে, কখন গ্রন্থাগার বন্ধ হয়েছিল তিনি তাও জানেননি ৷

সম্মানিত আলোচকবৃন্দ ও ছাত্র-ছাত্রী
আজ এ উদাহরণগুলো নিছক কল্পকাহিনির মতোই শোনায় । বই পাঠ কিংবা বই সংগ্রহ— এ সংস্কৃতি প্রায় উঠেই যাচ্ছে । আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী ও ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রেও একথা অনেকাংশে সত্য । প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা যতটা ইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশন নিয়ে সময় অতিবাহিত করি, সেক্ষেত্রে আমাদের পাঠের অভ্যাস গঠন করার সুযোগ আর কোথায়? অবশ্য এক্ষেত্রে আপনাদের অনেকেই বলবেন ই-বুকের কথা । আপনাদের জ্ঞাতার্থে সবিনয়ে বলছি যে, নিজের হাতে, কোলে নিয়ে যেভাবে পরম যত্নে কাগজে খোদিত বইটি পড়বেন; তা কি কম্পিউটারের স্ক্রিনে সম্ভব? বরং দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের ক্লান্তি, দেহের ক্লান্তি আসাই স্বাভাবিক ।

সুপ্রিয় সুধীজন
একসময় মানুষ প্রচুর পড়াশুনা করত । তারা বিনোদনের অন্যতম উপায় হিসেবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতো । ইদানীং এ বই পড়ার অভ্যাস অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা সত্যি দুঃখজনক । পূর্বেই বলেছি শিক্ষার্থীরা এখন পাঠক্রম বহির্ভূত কোনো বই না পড়ে শুধু টিভি, ফেইসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে । ফলে পাঠাভ্যাস বিমুখ একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠছে । এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমরা একটা জ্ঞানহীন জাতিতে পরিণত হব । আমাদের প্রযুক্তির উৎকৃষ্টতার সঙ্গে পাঠাভ্যাসের মধ্য দিয়ে মননশীলতা অর্জন করতে হবে ।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
পাঠাভ্যাসের প্রয়োজন শুধু মননশীলতা ও জ্ঞানার্জনের জন্যই নয় বরং গবেষণায় দেখা যায় যারা নিয়মিত বই পড়ে তাদের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে এবং মস্তিষ্ক সচল থাকে । ভাষা সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দভান্ডার বাড়তে থাকে, উচ্চারণ সুন্দর ও স্পষ্ট হয় । সম্প্রতি মার্কিন গবেষকরা বলেছেন, ‘একটি উপভোগ্য বই পড়ার পর মানুষের মস্তিষ্কের বাস্তব ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে ।' শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নাল, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ অনেক জার্নালে । সুতরাং পাঠাভ্যাস গঠন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে ।

প্রিয় সুধী
পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই । বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে অনেক বই-পুস্তক সমৃদ্ধ পাঠাগার রয়েছে, যা আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে । কিছু জায়গায় বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগেও পাঠাগার গড়ে ওঠেছে । এছাড়াও ‘আলোকিত মানুষ চাই' এই স্লোগানে সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালনা করছে, যা পাঠাভ্যাস গঠনে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে । তবে অনেক ক্ষেত্রে সকল পাঠকের উপযোগী বই না থাকায় কিছু পাঠক বঞ্চিত হচ্ছে । এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেই । এজন্য আমাদের সর্বস্তরের মানুষ ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে ।

সম্মানিত সুধী
সময়ের ফ্রেমে আমরা বন্দি; তাই এখনই শেষ করতে হবে। আর পড়ার অভ্যাস গঠনে ওমর খৈয়ামের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই আমার বক্তব্য শেষ করছি— 'রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলা হয়ে আসবে, তবু বই থেকে যাবে অনন্ত যৌবনা ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url