অভিজ্ঞতা বর্ণনা : একদিন ভাওয়াইয়া গানের আসরে
একদিন ভাওয়াইয়া গানের আসরে
ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গ তথা রংপুর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় গান । এই গানের ওপর গবেষণা করতেন আমার ছোটো চাচা । নানান স্থান থেকে একটি মাইক্রো ক্যাসেটে করে তিনি গানগুলো সংগ্রহ করে আনতেন, আর সাথে তার ক্যামেরায় গায়কের ছবি থাকতো । তখন অবশ্য আজকের মতো মোবাইল ফোনের এত প্রচলন ছিল না, তাই চাচা অনেক কষ্টে একবার গায়কের কাছে ক্যাসেট ধরতেন, আবার তার ছবি উঠাতেন । একদিন চাচা বললেন— চল আমার সঙ্গে । চাচা কোনো কিছু বললে আমি সচরাচর না করতে পারি না । তাই শুধু বললাম হুঁ । চাচার সঙ্গে চললাম নীলফামারীর উদ্দেশে । প্রথম পৌঁছলাম রংপুর; এরপর বাসে জলঢাকা তারপর তিস্তা ব্যারেজ পার হয়ে সোজা নীলফামারীর ডোমারে । এখানে বাসে আসতে আসতে আমার শরীরের প্রায় ১২টা বেজে গেছে । চাচা জিজ্ঞাসা করে কীরে খারাপ লাগছে নাকি? ততক্ষণ একটু সোজা হয়ে সপ্রতিভ হয়ে বলি, ‘না' । তিনি অবশ্য আমার অসুবিধা বুঝতে পেরেছেন । তাই ডোমারে নেমেই একটা খাবার হোটেলে নিয়ে গেলেন । সেখানে হাত-মুখ ধুয়ে বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত খেলাম । শরীর মন যেন জুড়িয়ে গেল । সেই সকালে তাড়াহুড়ো করে ভাত খেতে পারিনি। সত্যি ভাত ছাড়া আমার আর অন্যকিছু তেমন পছন্দ নয় । চাচা এবার একটা রিকশা নিয়ে বললেন, ‘চল’ । কিন্তু কোথায় যাচ্ছি ভেবে পাচ্ছিলাম না । ডোমার একটি ছোটো শহর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা গ্রামে ঢুকলাম । অবশ্য, পাকা রাস্তা দিয়ে একটু যেতেই দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । চাচাকে দেখেই বললেন, ‘কীরে খুব কষ্ট হয়েছে বুঝি?’
আমি অবাক হলাম, উনি আবার কে? চাচা রিকশা থেকে নেমেই আমাকে পরিচয় করে দিলেন— ‘ও শাওন- আমার ভাইয়ের ছেলে । ভদ্রমহিলা বেশ আদর করে আমার হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে গেলেন । পরে বুঝলাম উনি চাচার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী । উনি আমাদের নাস্তা কী করাবেন, তা নিয়ে যখন ব্যতিব্যস্ত হলেন, তখন চাচা বললেন— 'না, প্রয়োজন নেই— একেবারে হোটেল থেকে ভাত খেয়ে এসেছি । রাতে খাব । খাবার কথা শুনে তিনি বললেন- 'সে কী...।' রাতে চাচা ভালো করে বোঝালেন, আসলে আমার কাজটি কী হবে? তিনি বললেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত শিল্পীর গান নেব না । আমরা একেবারে গ্রামের অশিক্ষিত-দরিদ্র শিল্পীর গান সংগ্রহ করব।' আর এক্ষেত্রে আমাকে সুন্দরভাবে গান পরিবেশন অবস্থায় ক্যামেরায় ছবি উঠাতে হবে । মূলত ছবি উঠানোই আমার কাজ । পরের দিন সকালে দুচার জন শিল্পী এসে হাজির । কীভাবে যেন খবর পেয়েছেন— আমরা এ কাজে এসেছি । কিন্তু চাচা বললেন— 'আমি আপনাদের গান শুনব কিন্তু পরে ।' আমরা পায়ে হেঁটে এক গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলাম— দুই-একজনকে চাচা ভাওয়াইয়ার গায়ক সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন । পরে জানলাম মতিয়ার নামে একজন গায়ক আছে । তবে এ গ্রামে নয় ঐ গ্রামে । কী আর করার । আমরা চললাম । পেছন থেকে একজন ডেকে বললেন, ‘এ্যাটে তো মতিয়্যার' । দেখলাম এখানকার অন্যতম ফসল আদার খেতে নিড়ানির কাজ করছে । পরনে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মালকোঁচা মেরে পড়েছে । আমাদের দেখামাত্রই মালকোঁচটা খুলে সালাম দিলেন । গান জানে কি-না- প্রশ্নে প্রথমেই তিনি না করলেন । কিন্তু ততক্ষণে গ্রামের আর প্রায় দশ-বারো জন এসে উপস্থিত । তারাই বরং বললো ‘ওমাক গান শুন্যাবু ন্যা কেন?' অগত্যা তিনি বাড়ি থেকে দোতারা নিয়ে আসলেন । আদার খেতে যে ‘ড্যারা' অর্থাৎ পাহারা দেওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দোতলার ঘর— সেখানেই বসল গানের আসর । দোতারার মনোমুগ্ধকর সুরে আরও লোকজন এসে উপস্থিত হলো । গান শুরু হলো— ‘আজি ধিকো ধিকো ঐ মইষাল ধিকো তোমার হিয়া, কোন পরানে যাইবেন মইষাল মোকে ছাড়িয়া...' এ অঞ্চলের জনপ্রিয় মইষালী ভাওয়াইয়া গান । এরপর গাইলেন—
নোদীও না যান বইদো—
ঐনা নদীর ঘোলারে ঘোলা পানি
মুই নারী তুলিয়্যা দেইম পানি -
নারীর অপরিসীম আকুতিতে ভরপুর সকল গান । এ গানে যেন আবহমান বাংলার প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় । বিকেলের শেষে আসর ভাঙল; আমরা ফিরতে চাচ্ছি । কিন্তু গায়ক মতিয়ার বললো, তার বাড়িতে যেতে হবে । চাচা যখন বললো, ‘আজ সময় নেই' । তিনি তখন বললেন— ‘তাইল্যা মোর গান মোক ফিরি দ্যাও।' অর্থাৎ সে নাছোড়বান্দা । আমরা তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা খড়ের ঘর, একপাশে বাঁশের বাতারি দিয়ে তৈরি মাচা; ঘরের দরজাটিও বাঁশের তবে আধাভাঙা; বেড়াগুলো অর্ধেক নষ্ট হয়েছে । মেঝেতে এক ছেঁড়া মাদুরে বসলাম— মতিয়ারের বউ এক গামলা ভর্তি ভাত আর মোরগের মাংস নিয়ে হাজির হলেন । এতক্ষণে বুঝলাম, এজন্যই মতিয়ারের এত আপত্তি । কোনো ধরনের সংকোচ না করেই মতিয়ারের বউ আমাদের খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন । এক পরম তৃপ্তিতে যেন খেলাম ।
শুধু অনুভব করলাম এ গায়করা অন্য ধরনের মানুষ । তাদের গলায় স্রষ্টা যেমন সুর দিয়েছেন তেমনি ওদের মনও। চাচা শুধু বললেন— ‘দেখেছিস, লোকশিল্পীদের হৃদয় কত বড়ো!' এরপর ফেরার পালা ।