জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা
[সংকেত: ভূমিকা; জীবনচরিত বলতে যা বোঝায়; জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা; জীবনচরিত স্পর্শমণি স্বরূপ; জীবনচরিত নির্বাচন; জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা; উপসংহার ।]
ভূমিকা :
মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়
সেই পথ লক্ষ করে, স্বীয় কীর্তি-ধ্বজা ধরে
আমরাও হব বরণীয় ।
জ্ঞানী-গুণী ও মহৎ মানুষেরা আমাদের কাছে অনুসরণীয় । তাঁরা যে পথ অনুসরণ করে জীবনে বড়ো হয়েছেন, তাঁদের উত্তর প্রজন্মের কাছে নমস্য হয়েছেন, হয়েছেন স্বনামখ্যাত ও অমর, আমাদেরও সেই পথ অনুসরণ করা উচিত । মানবসমাজে যাঁরা অসাধারণ কিংবা অনন্য সাধারণ, যাঁদের মধ্যে মনুষ্যত্বের অপার বিস্ময় বিরাজমান— আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি, বিনম্রচিত্তে স্মরণ করি । হৃদয়ের ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের উদ্দেশে রচনা করি অর্ঘ্য-ডালা । আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁদের অমূল্য জীবনচরিত পাঠ করি এবং জীবনকে সেভাবে বিকশিত করে তোলার প্রয়াস চালাই । অতএব, আমাদের জীবন সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার পন্থা হিসেবে মনীষীগণের কীর্তিময় গৌরবগাথা তথা তাঁদের আদর্শ জীবনচরিত পাঠ করা একান্ত আবশ্যক ।
জীবনচরিত বলতে যা বোঝায় : জীবনচরিত হলো কোনো মহৎ ব্যক্তির জীবনী বা তাঁর জীবনের ইতিহাস । অর্থাৎ যে গ্রন্থে কোনো ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনা ও চরিত্রের বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকে তাকে জীবনচরিত বলে । এরকম কীর্তিমান কোনো মহাপুরুষের জীবন-বৃত্তান্ত সংবলিত গ্রন্থই আমরা জীবন-পথের অনুসরণীয় পাথেয় হিসেবে পাঠ করে থাকি । দেশে দেশে, কালে কালে কখনো কখনো জন্ম নেন এক-একজন অসাধারণ, ক্ষণজন্মা মানুষ । তাঁরা অপরাজেয় পৌরুষের অধিকারী, মনুষ্যত্বের সাধক, হৃদয়-ঐশ্বর্যে মহীয়ান, মহৈশ্বর্যে নম্র । তাঁরা মহাদৈন্যেও উন্নত-মস্তক, সম্পদে কুণ্ঠিত, বিপদে নির্ভীক । তাঁরা আমাদের শুভ অভীপ্সার প্রতীক, পরবর্তী প্রজন্মের নতুন ঠিকানা। তাঁরা যুগে যুগে স্মরণীয়, বন্দিত মহাপুরুষ । তাঁদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে আমরা নিবেদন করি ভক্তির অর্ঘ্য । তাঁদের মহৎ জীবনগাথা স্মরণ করে আমরা জীবনীশক্তি সংগ্রহ করি, মনুষ্যত্বের সম্পদ অর্জনে উদ্বুদ্ধ হই । এমন সব মহীয়ান জীবনের কাহিনি অবলম্বন করেই রচিত হয় জীবনচরিত; যে জীবনচরিতের মহাজ্ঞানী-মহাজনরা উত্তর প্রজন্মের কাছে দেবজ্ঞানে পূজনীয় এবং তাঁদের জীবনী আদর্শ হিসেবে পালনীয়। এমন মহৎজনের প্রদর্শিত পথ ধরেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হতাশায় আশার আলো দেখতে পায়, শোকে পায় সান্ত্বনা, দুঃখে শক্তি অর্জন করে এবং সমূহ বিপর্যয়েও বিরাট সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।
জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা : মহৎজীবনী পাঠের উপকারিতা গভীর ও ব্যাপক । জীবনচরিত পাঠ দুদিক থেকে কল্যাণজনক । একদিকে যেমন তা সৃষ্টিকর্ম হিসেবে পাঠককে আনন্দ প্রদান করে তেমনি অপরদিকে তা থেকে প্রচুর শিক্ষা লাভ করা যায় । এক্ষেত্রে জীবনচরিতকে একটি আদর্শ দর্পণ বলে অভিহিত করা যায় । এতে পাঠক নিজ চরিত্রের প্রতিফলন অবলোকন করতে পারে । শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে পরিচিত হয়ে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, সত্যকে আবিষ্কার করে । মানুষ নবতর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে । তাছাড়া মানুষ মহৎ জীবন প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়, সৎকর্মে প্রলুব্ধ হয়, জীবনকে একটি সুনিয়ন্ত্রিত পথে পরিচালিত করে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য পূরণে তৎপর হয়ে ওঠে। জীবনচরিতে মানব-জীবনের বিচিত্র রহস্য প্রতিফলিত হয়, ফলে মানবহৃদয়ের অতলান্ত রহস্যের যে গুপ্ত অভিব্যক্তি তা পাঠকের মনকে আকর্ষণ করে । সর্বোপরি জীবনচরিত পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষ মানবমনের বিচিত্র সমস্যার সমাধান ঘটাতে পারে বলে মহৎ ব্যক্তির জীবনী পাঠের উপকারিতা অনস্বীকার্য ।
জীবনচরিত স্পর্শমণি স্বরূপ : মহাপুরুষগণের জীবনচরিত আমাদের প্রাণে ঢেলে দেয় দুঃখ জয়ের অমৃতবাণী । তা মৃত্যু-জয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত করে আমাদের যথার্থ মানুষ হওয়ার আলোকিত পথ দেখায় । মহামনীষীদের জীবনীর মধ্যে এক অমোঘ শক্তি আছে, আছে স্পর্শমণির আশ্চর্য মাহাত্ম্য । এর দৈবিক ছোঁয়ায় অসুন্দর সুন্দর হয়ে ওঠে, ক্ষুদ্র হয় বৃহৎ এবং ইতরও মহৎ হয় । জীবনীপাঠ আমাদের মধ্যে মহৎ আদর্শের বীজ বপন করে । কালে কালে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরূহে পরিণত হয় । সেই মনুষ্যত্বের মহীরূহে তখন মানবিক গুণাবলির ফল ফলতে শুরু করে। বস্তুত তখন আমাদের নবজন্ম হয় । মানুষ জাতি হিসেবে আমরা দ্বিজ । অর্থাৎ আমাদের দুই বার জন্ম হয় । একবার মাতৃজঠর ছিন্ন করে আমরা মাটির মানুষ হিসেবে মৃত্তিকায় ভূমিষ্ঠ হই, দ্বিতীয়বার বিদ্যা-শিক্ষা চর্চার দ্বারা মনুষ্যত্ব অর্জন করে প্রকৃত মানুষরূপে আমরা আত্মপরিচয় লাভ করি । এই দ্বিতীয় জন্ম তথা মনুষ্যত্ব অর্জনে মহৎ মানুষের জীবনীপাঠ সুবিশেষ সহায়ক । এর ফলে ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে আমরা মানবিকতার মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারি । জীবনচরিত স্পর্শমণির প্রভাবেই আমরা আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে নানা মহান কাজে উৎসর্গ করতে ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করি । মহৎপ্রাণ উন্নত আত্মা প্রতিভাবান ব্যক্তিরা অজস্র কল্যাণকর্মের মধ্যে রেখে যান তাঁদের অমলিন পরিচয়, মহিমান্বিত কীর্তির গৌরব । তাই সেই চিরভাস্বর মহৎ জীবন আমাদের চিরন্তন সত্যের দিকেই বারংবার আকর্ষণ করে, যে সত্য অমরত্বের গৌরবে উজ্জ্বল ।
জীবনচরিত নির্বাচন : জীবনচরিত নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । কেননা আমি কার জীবনী পড়তে চাই এবং কেমন জীবন গড়তে চাই এই দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুনির্বাচন অতীব জরুরি। বর্তমানে পৃথিবীতে অনেকেরই জীবনচরিত রচিত হয়। কিন্তু যে জীবনচরিত আমাদের দুঃখ জয়ের প্রেরণা দেয় না, যে জীবনচরিত আমাদের মহত্ত্বে অনুপ্রাণিত করে না, যে জীবনচরিত আমাদের মানবতার বৃহত্তর আদর্শে উজ্জীবিত করে না, যে জীবনচরিত আমাদের যথার্থ জীবনপথ নির্দেশ করে না, সেরূপ জীবনচরিত পাঠের কোনো সার্থকতা নেই । প্রকৃতপক্ষে বর্তমানকালে প্রকাশিত জীবনচরিতের ভেতরে প্রকৃত মহাপুরুষের জীবনী নির্বাচন এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। চরিতগ্রন্থের এই বিপুল ভিড়ে আমাদের খুঁজে নিতে হবে সেই পরম বাঞ্ছিত জীবনীকে, যে জীবনচরিত আমাদের কর্মপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে; যেখানে থাকে দুঃখ জয়ের বলিষ্ঠ-অঙ্গীকার । যে মহাজীবন সংকীর্ণ ক্ষুদ্র স্বার্থমগ্ন জীবনের আবেষ্টনী থেকে আমাদের বৃহৎ জীবনের বেদিতলে নিয়ে আসে; আমাদের আত্মবিসর্জনে অনুপ্রাণিত করে; যাঁদের স্মরণ করলে আমাদের জীবন মহত্ত্বের পথে ধাবিত হয়, সেই জীবনচরিতই আমাদের অবশ্যপাঠ্য । যে জীবন সাধশূন্য সাধুত্বে পূর্ণ, যে জীবন বীরত্বে মহামহিম, ত্যাগ ও মহত্তে প্রোজ্জ্বল, এমন জীবনাধিকর্তারাই আমাদের আরাধ্য, আমাদের নমস্য । যাঁরা আমাদের অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান, যাঁরা আমাদের মন্দ থেকে ভালোয় পরিণত করেন, যাঁরা আমাদের মায়াবদ্ধ জীবনে মুক্তির দূত, সভ্যতার প্রাণপুরুষ, প্রগতির পথ-নির্দেশক, যাঁরা অকৃত্রিমতা ও ধ্রুবতায় সংযত সমাহিত, যাঁরা বুক পেতে সংসারের অশেষ নির্যাতন সহ্য করেছেন, যাঁরা স্বৰ্গ থেকে মর্ত্যে অমৃতপাত্র এনেছেন, অথচ পান করেছেন সংসার-সমুদ্র মন্থনের সুতীব্র গরল, যুগ যুগ ধরে তাঁদেরই জীবনচরিত আমাদের আদর্শ এবং অবশ্যপাঠ্য । প্রত্যহ তাঁদের স্মরণ করা আমাদের নৈতিক কর্ম এবং মানবিক ধর্ম বলে বিবেচ্য । অতএব, আদর্শ জীবনচরিত নির্বাচনে প্রাজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া অনিবার্য ।
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা : মানুষকে অনাগত ভবিষ্যতের অন্ধকার পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো একটি আলোকবর্তিকার প্রয়োজন হয়। জীবনচরিত সে দায়িত্ব পালন করে থাকে । জীবনকে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায় জীবনচরিতের মধ্যে। জীবনীতে প্রতিফলিত আদর্শকে অনুসরণ করে মানুষ তার নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে । জীবনের এই বিশেষ তাৎপর্যের কারণেই জীবনচরিত পাঠ করা একান্ত প্রয়োজন । প্রকৃতপক্ষে মহাপুরুষের জীবন দেশ-কাল-বিচ্ছিন্ন কোনো একক ব্যক্তিত্ব মাত্র নয় । বরং নানা ঘটনার তরঙ্গে আন্দোলিত সে মহাজীবন। তাই মনীষীদের জীবনচরিত পাঠে আমরা এক এক দেশের সমাজ-সভ্যতা, রাজনীতি-ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে নানা তথ্য জানতে পারি । জীবনীগ্রন্থ তাই অলক্ষ্যে হয়ে ওঠে ইতিহাসের অন্যতম উপাদান । তাই একাধিক বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।
উপসংহার :
সময় সাগর তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে
আমরাও হব যে অমর
সেই চিহ্ন লক্ষ করে, অন্য কোন জন পরে
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর ।
জীবনের আনন্দ এবং সার্থকতা কর্ম সম্পাদনের মাঝে নিহিত । মহৎ ব্যক্তিগণ অমর কীর্তি দ্বারা পৃথিবীর বুকে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন । তাঁদের মতো কর্মোদ্দীপনাকে পাথেয় করে আমরা সম্মানের স্থান অধিকার করব । আর তার জন্য মহব্যক্তিদের জীবনচরিত পাঠ করা আদর্শ জীবন নির্মাণের প্রথম সোপান। জীবনচরিতের মধ্যে আদর্শ মানুষের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয় । জীবনচরিত থেকে পাঠক যদি যথার্থ শিক্ষা অর্জন করতে পারে তবেই জীবনী পাঠ সার্থক হয় । বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই মানুষ দিশেহারা, বিভ্রান্ত। চারপাশে শুধু আত্মকেন্দ্রিক, বিবেকহীন, নির্মম প্রতিযোগিতার মত্ততা। বর্তমানের এই হিংস্র দুঃসময়ের বিভীষিকার পথ উত্তরণের জন্য প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি । বর্তমানের এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে মহৎ মানুষের জীবনচরিত পাঠেই সবার আত্মশুদ্ধি ঘটবে, মানুষ খুঁজে পাবে অমৃতের সন্ধান । কেননা মানুষ চিরদিনই আলোর পথের যাত্রী, অমৃতের সন্ধান করাই তার জীবনের উদ্দেশ্য ।