বাংলা রচনা : ছাত্রী উপবৃত্তি

ছাত্রী উপবৃত্তি

ছাত্রী উপবৃত্তি
অথবা, নারী শিক্ষা বিস্তারে উপবৃত্তির ভূমিকা

[সংকেত : ভূমিকা; সামাজিক অবস্থানে নারী শিক্ষা; নারী শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা; নারী শিক্ষায় সরকারের উদ্যোগ; নারী শিক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ; উপবৃত্তি সম্প্রসারণ; ছাত্রী উপবৃত্তির সুফল; কর্মসূচি বাস্তবায়নে করণীয়; উপসংহার ।]

ভূমিকা : মানব জাতির একটি বিরাট অংশ নারী । নারী ছাড়া কখনো কোনো পুরুষ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারেনি । বর্তমান যুগে দিকে দিকে নারীর জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে । বাংলাদেশে মুখে মুখে নারী-পুরুষের সমানাধিকার দেওয়া হলেও এখনও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে আছে । যেমন— কোনো কোনো বাবা তার ছেলের লেখাপড়ার জন্য অনেক টাকা খরচ করেন, কিন্তু মেয়ের জন্য বেশি খরচ করতে নারাজ । অথচ আজকের দিনের মেয়েটি আগামী দিনের মা । আর এই মা জাতি গঠনের সবচেয়ে বড়ো কারিগর । জাতি শিক্ষিত হলে দেশের দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব । আর একটি জাতি শিক্ষিত হতে হলে শিক্ষিত মা প্রয়োজন । তাই আমাদের দেশের নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে । নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । তার মধ্যে নারী শিক্ষায় উপবৃত্তি অন্যতম ।

সামাজিক অবস্থানে নারী শিক্ষা : আমাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ নিরক্ষরতা মুক্ত না হওয়া । এর অন্যতম কারণ নারী শিক্ষার অবমূল্যায়ন । কুসংস্কার, হীন দৃষ্টিভঙ্গি ও আর্থনীতিক দিক থেকে পুরুষশাসিত সমাজ আজও নারীদের সমানাধিকার দিতে নারাজ । ফলে নারী শিক্ষার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ থাকলেও তা সফল হচ্ছে না । আর নারী শিক্ষার অভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে । তাই দেশ ও জাতির উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়কে সমান ভূমিকা রাখতে হবে । সেই জন্য চাই শিক্ষিত নারী । কারণ নারী শিক্ষিত হলে জাতি শিক্ষিত হবে । আর জাতি শিক্ষিত হলে দেশের উন্নতি সম্ভব । তাইতো ফরাসি দার্শনিক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেনー

আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। 

নারী শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা : সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন —

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ৷

পৃথিবীর প্রতিটি বড়ো বড়ো কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রয়েছে । পৃথিবীর সব বড়ো যুদ্ধে নারীরা অংশগ্রহণ করেছে, পুরুষের পাশে থেকে প্রেরণা যুগিয়েছে । নারীর সহায়তা ছাড়া কোনো কালেও পুরুষ জয়ী হতে পারেনি । সৃষ্টির প্রথম থেকে জীবিকা নির্বাহে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান ছিল যথেষ্ট । তাছাড়া মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরাই অধিকাংশ কাজ করে । আদিম যুগের নারীরা গৃহস্থালি কাজ থেকে শুরু করে কৃষিকাজ এমনকি বনে শিকারও করত । কিন্তু বর্তমান যুগে উন্নত দেশে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সর্বক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে । জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীরা অবদান রাখতে পারলে একটি সমৃদ্ধ দেশ গঠন করা সম্ভব হবে এবং জাতির উন্নতি ত্বরান্বিত হবে । আর এ জন্যই প্রয়োজন নারী শিক্ষা । এখনও বাঙালি নারীরা বিভিন্ন কারণে শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে । আমাদের দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন নারীদের শিক্ষিত করে তোলা । তাই সরকার মেয়েদের শিক্ষায় আগ্রহী করার জন্য এবং আর্থিক সহায়তার জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও উপবৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে ।

নারী শিক্ষায় সরকারের উদ্যোগ : বাংলাদেশে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা প্রচলিত । বর্তমানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না । অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে, বিশেষ করে অর্থের অভাবে নারীরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে । পরিবারে একটি ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বাবা-মা অনেক অর্থ খরচ করতে আগ্রহী থাকে । কিন্তু একটি মেয়ে শিশুকে অর্থ খরচ করে শিক্ষিত করতে অনাগ্রহ দেখা যায় । বাবা-মা মনে করেন একটি মেয়েকে সামান্য লেখাপড়া শিখিয়ে পাত্রস্থ করাই তাদের কর্তব্য । ফলে মেয়েরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে অথবা কেউ কেউ সামান্য শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। সরকার আমাদের সমাজের এই মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে উদ্যোগ নেয় । মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে । তাছাড়া আর্থিক সমস্যার কারণে যাতে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ না হয় এবং বাবা-মা যেন মেয়ে শিশুকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হন সেজন্য সরকার বিনা-বেতনে মেয়েদের শিক্ষা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে ।

নারী শিক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ : উন্নত দেশের নারীরা উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। দেশ ও জাতি গঠনে নারীর অংশগ্রহণ ও নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে । নারী ক্ষমতায়ন ও সামগ্রিক উন্নয়নকল্পে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত নারী মুক্তি সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৭৯টি দেশ স্বাক্ষর করে । তখন থেকে বাংলাদেশে নারী শিক্ষা বিস্তারে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক,আইডিবি, এডিবি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়। বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশে নারী শিক্ষা বিস্তারে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয় ।

উপবৃত্তি সম্প্রসারণ : ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উপবৃত্তি চালু করেন । পরবর্তী সময়ে তা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়। এর ফলে মেয়েরা তাদের অভিভাবকদের সম্মতিতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয় । তাছাড়াও একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে মেয়েদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ভর্তি ফি, বই কেনা, পরীক্ষা ফি ও রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ সর্বসাকুল্যে তিন হাজার তিন শত টাকা প্রদান করা হয়। ফলে গ্রামের দরিদ্র ও অসচেতন অভিভাবকরা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে মেয়েরা সামনে এগিয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছে ।

ছাত্রী উপবৃত্তির সুফল : বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী । তাই দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীরও ভূমিকা রাখতে হবে। আর এজন্য চাই শিক্ষিত নারী। নারীদের শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য সরকার উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে । এতে শিক্ষার প্রতি নারীদের এবং অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরে স্কুল-কলেজে ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, বাল্যবিবাহ কমেছে, মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকরা সচেতন হয়েছে । নারীরা এখন স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশ ও জাতির উন্নতিতে অবদান রাখছে ।

কর্মসূচি বাস্তবায়নে করণীয় : নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য সরকার ছাত্রী উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। এতে শিক্ষার প্রতি নারীদের আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছাত্রী উপবৃত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে । শিক্ষা বিভাগের তদারককারী কর্মকর্তারা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ এ দুর্নীতির সাথে জড়িত। এ দুর্নীতি রোধের জন্য শিক্ষা বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের এবং শিক্ষকমণ্ডলীকে সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে । তাছাড়া দেশের সুশীল সমাজকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে কেউ এ বিষয়ে দুর্নীতি করতে না পারে । আর সরকারকে এ উপবৃত্তির পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে ।

উপসংহার : নারীশিক্ষা বৃদ্ধির জন্য যে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উপবৃত্তি কর্মসূচি সবচেয়ে প্ৰশংসনীয় উদ্যোগ। সরকারের এসব উদ্যোগকে দেশবাসী বাহবা জানিয়েছে। এতে অনেক অভিভাবক মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে । অতীতের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে । নারী শিক্ষা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে শিক্ষার হার যেমন বাড়ছে তেমনি দেশ ও জাতির উন্নতি হচ্ছে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url