বাংলা রচনা : মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা
 
মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব
অথবা, মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা

[ সংকেত : ভূমিকা; মানবসম্পদ; মানবসম্পদ উন্নয়ন; মানবসম্পদ উন্নয়নের সংজ্ঞার্থ; মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা ; মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব; মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার অবদান; আমাদের করণীয়; উপসংহার ।]

ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। স্রষ্টা মানুষকে হাত, পা ও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন । শুধু মানব সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জিত হয়ে যায় না । মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই প্রতিপন্ন হয়, যখন মানুষ নিজের কর্ম ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে নিজেকে সার্থক প্রমাণ করতে পারে । আর সেটা অর্জন সম্ভব হয় কেবল শিক্ষার মাধ্যমে । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে যোগ্য ও উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় । শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে আত্মশক্তি ও মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন করে তাকে উন্নততর মানুষে পরিণত করা । শিক্ষার মাধ্যমে দেশের মানুষকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা যায়। শিক্ষিত জনশক্তিই একটি দেশের মূল্যবান সম্পদ। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য ।

মানবসম্পদ : সাধারণভাবে মানবসম্পদ বলতে মানুষকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করাকে বোঝায় । বাস্তবিক পক্ষেই বর্তমান বিশ্বে মানুষকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একটি দেশের জনসংখ্যার কর্মঠ ও দক্ষ জনগোষ্ঠীই হলো সেদেশের মানবসম্পদ । অদক্ষ জনশক্তি একটি জাতির জন্য অভিশাপ। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তির বড়োই অভাব । এর কারণ হলো শিক্ষার অভাব। শিক্ষা মানুষকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে। এর মধ্যে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা অতি সহজেই মানুষকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারে ।

মানবসম্পদ উন্নয়ন : মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে বোঝায় মানুষকে প্রতিটি কাজের জন্য যথাযোগ্য করে গড়ে তোলা । অর্থাৎ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ করে তার সহজাত ও সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ দিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলাই হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন । জন্মগতভাবেই মানুষ কিছু সুপ্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে । উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের মাধ্যমে মানুষের সেই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটতে পারে । মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যতীত একটি দেশ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। মানবসম্পদ যত কর্মঠ হয় জাতির উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হয়। শিক্ষাকে বর্তমান বিশ্বে মানবসম্পদ উন্নয়নের হাতিয়ার বলে বিবেচনা করা হয়।

মানবসম্পদ উন্নয়নের সংজ্ঞার্থ : বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা মানবসম্পদ উন্নয়নকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেনー

ফ্রেডারিক হার্বিসন ও চার্লস এ মায়ার্স-এর মতে, "মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার মাধ্যমে কোনো সমাজের সকল মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।"

বিশ্বব্যাংকের মতে, “মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কোনো রাষ্ট্রের মানুষের সামগ্রিক বিকাশ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের জনশক্তি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে ।"
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করেছে । 

মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা : বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। এদেশের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই । অথচ আমাদের অধিকাংশ লোকই অদক্ষ ও অজ্ঞ । এই অদক্ষ লোকজন দেশের কোনো উন্নয়নে কাজে আসে না'। কেননা এসব অদক্ষ লোক কোনো কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে না । একজন শিক্ষিত ও দক্ষ লোক একটা কাজে যতটা সাফল্য অর্জন করতে পারে একজন অশিক্ষিত ও অদক্ষ লোকের পক্ষে তার কিছুটাও সম্ভব নয় । অন্যদিকে, একটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে দক্ষ মানবসম্পদের ওপর। শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ না থাকলে দেশের সমুদয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড । একটি জাতিকে উন্নত করতে হলে সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে । যেকোনো দেশের আর্থনীতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই । কোনো দেশের জাতীয় উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য প্রথমে সেদেশের মানবসম্পদের উন্নয়ন করা অতীব জরুরি । আর এটা কেবল সম্ভব হবে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলন করতে পারলে । শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানশক্তির দ্বার খুলে দেয় । মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে একমাত্র শিক্ষা । একজন শিক্ষিত লোক দেশের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারে । আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত । কেননা আমাদের দেশে এমন অনেক শিক্ষিত লোক আছে, যারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না । ফলে বেকার জীবনযাপন করছে । অর্জিত শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে না পারলে মানবজাতিকে যথাযথভাবে মানবসম্পদে পরিণত করা যাবে না । আমাদের দেশে বাস্তবমুখী শিক্ষার সুযোগ না থাকায় বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে । ইদানীং কিছু কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে । কিন্তু এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য। তাই জাতীয় অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার অবদান : মানুষকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন । এজন্য সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ, সেই সাথে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলা ও যথাযথ প্রযুক্তি নির্দিষ্টকরণ এবং তা প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আর দেশের জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে। যেমন—

(ক) শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও বিচার শক্তির বিকাশ ঘটায় : শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের অন্তর আলোকিত হয় না। একমাত্র শিক্ষাই পারে মানুষের মেধা শক্তিকে জাগ্রত ও বিকশিত করতে। ফলে মানুষ সুপরিকল্পিত চিন্তা ও বিচার-বিবেচনার মধ্যদিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে।

(খ) শিক্ষা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে : শিক্ষা মানুষের আত্মসচেতনতা ও আত্মশক্তি বাড়িয়ে দেয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভে সাহায্য করে । এর মাধ্যমে প্রত্যেকে তার প্রচলিত সমাজব্যবস্থার রীতিনীতি, জীবনব্যবস্থা, সামাজিক অবস্থা ও. ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারে । ফলে নিজেকে ও সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়।

(গ) শিক্ষা জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে : নিরক্ষর ব্যক্তিরা কখনো আত্মসচেতন ও নিজেদের অধিকার সচেতন নয় । এরা যেকোনো ভালো-মন্দ কাজে সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে কুচক্রী লোকেরা অতি সহজেই তাদের বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করতে পারে। কিন্তু তারা সাক্ষর হলে নিজের আগ্রহে সুবিধামতো বইপত্র, সংবাদপত্র প্রভৃতি পড়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে। তখন নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তারা পরিবারের ও দেশের কল্যাণ সাধনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।

(ঘ) শিক্ষা মানুষের মধ্যে সমাজসচেতনতা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত করে : শিক্ষা মানুষের মধ্যে সমাজসচেতনতা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত করে। তারা বুঝতে শেখে নিজের স্বার্থ দেখলেই চলবে না, সকলের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে । তখন তারা সমাজের উন্নয়ন সাধনের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে।

(ঙ) শিক্ষা মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে : একজন নিরক্ষর কর্মীর চেয়ে একজন সাক্ষর কর্মী অধিক কর্মদক্ষ । কারণ একজন সাক্ষর কর্মীর চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা, আত্মমূল্যায়ন, কর্মসূচি গ্রহণ ও কর্মসম্পাদনের ক্ষমতা নিরক্ষর কর্মী থেকে অনেক বেশি ।

(চ) জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শিক্ষা : শিক্ষা মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে স্পৃহা জাগায়। ফলে সে সমাজের অন্যদের জীবনযাত্রার মানের সাথে তুলনা করে নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চেষ্টা করে ।

আমাদের করণীয় : বাংলাদেশের জনসংখ্যা মোট সম্পদ ও আয়তনের তুলনায় অতিরিক্ত । একারণে আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। এর জন্য একমাত্র উপায় হলো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এ মানবসম্পদকে উৎপাদনমুখী কাজে সহায়তা করা। তাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। তবেই এদেশের মানুষ মানবসম্পদে পরিণত হবে ।

উপসংহার : শিক্ষা মানুষের অজ্ঞতা দূর করে সমাজ সচেতন করে তোলে । আর একজন শিক্ষিত মানুষ দেশের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয় । শিক্ষিত ব্যক্তি দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসে । তাই দেশের প্রতিটি মানুষকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url