বাংলা রচনা : যুবসমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকার
যুবসমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকারঅথবা, যুবসমাজ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়
[ সংকেত : ভূমিকা; যুবসমাজ ও অবক্ষয়; যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ; উপযুক্ত আদর্শ ও মূল্যবোধের অভাব; জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রভাব; ছাত্র রাজনীতি; পরিবর্তনশীল রাজনীতি; মাদকাসক্তি; শিক্ষাঙ্গনে নকল ও সন্ত্রাসের প্রচলন; সামাজিক পরিবেশ; বেকারত্ব; যুবসমাজের অবক্ষয়ের প্রতিকার; উপসংহার ।]
ভূমিকা :
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি ।
তরুণরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার । তারা দেশ ও জাতির শক্তি ও ভরসা । তাদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিহিত । এই সকল তরুণের কাঁধেই জাতি ভবিষ্যৎ দায়িত্ব-ভার দিয়ে দেশের কল্যাণ ও উন্নতির প্রত্যাশা করে । কিন্তু আমাদের দেশের তরুণরা আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত । নানা সমস্যার কারণে যুবসমাজ বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । যে যুবসমাজ যুগে যুগে অন্ধকার থেকে পৃথিবীকে আলোর দিকে নিয়ে এসেছে, সেই যুবসমাজকে চরম অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করা দেশ ও জাতির কর্তব্য । এই যুবসমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে তাদের অধঃপতনের কারণ খুঁজে বের করে তার প্রতিকার করতে হবে ।
যুবসমাজ ও অবক্ষয় : আজকের তরুণরা আগামী দিনের কান্ডারি । তারাই পারে জরা-জীর্ণ সমাজজীবনকে জীর্ণতামুক্ত করে সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে, পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে সৃষ্টি করতে । যুবকদের চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন থাকে । চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তারা সম্মুখপানে এগিয়ে চলে, ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেয়, বুকভরা বিশ্বাস নিয়ে নবজীবনের সংগীত রচনায় সামনে এগিয়ে চলে । তরুণরা কখনো পিছু হটতে জানে না, তারা সম্মুখে এগিয়ে চলে, তারা সদা চঞ্চল, তারা পরাজয় মানতে নারাজ, দেশ ও জাতির গৌরব। তরুণরা সবসময় থাকে গতিশীল, প্রাণোচ্ছ্বল, সামাজিক প্রয়োজনে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে, দেশমাতৃকাকে রক্ষা করে বিপদের হাত থেকে। কিন্তু এই যুবসমাজই উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে একসময় তাদের গতিপথ হারিয়ে ধ্বংসের পথে চলে যায়, বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বই, খাতা ও কলমের পরিবর্তে তাদের হাতে ওঠে অস্ত্র। এতে যুবসমাজে অবক্ষয় নেমে আসে । অনিশ্চিত এক ভয়ংকর পথে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। যুবসমাজের এই বিপথগামিতার কারণে জাতীয় অধঃপতন শুরু হয়, জাতি চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় ।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ : আমাদের সমাজ আজ নানা সমস্যায় আক্রান্ত। এইসব সমস্যা যুবসমাজকেও অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে। যে যুবসমাজের কাঁধে ভর দিয়ে দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছায়, সেই যুবসমাজই আজ নীতির কাছে পদদলিত, নৈতিকতা বিসর্জিত । নানা সমস্যার কারণে আমাদের যুবসমাজ আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। বিভিন্ন দৈন্য দশা যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে । যার কারণে যুবসমাজ আজ অবক্ষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে । নিম্নে যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
উপযুক্ত আদর্শ ও মূল্যবোধের অভাব : মানবসমাজ আজ অন্যায়, মিথ্যাচার আর অপকর্মে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সমাজে উপযুক্ত আদর্শ ও মূল্যবোধের অভাব দেখা দিয়েছে । যুবকরা বড়োদের মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধের সন্ধান না পেয়ে দিন দিন মিথ্যাচার, অপকর্ম ও অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তারা দেখতে পাচ্ছে রাজনীতিবিদরা রাজনীতির নামে ক্ষমতা দখল করছে আর নিরীহ মানুষের ওপর জুলুম করছে, সত্যের নামে প্রতারণা করছে, সমাজসেবার নামে স্বেচ্ছাচার করছে । মানব সমাজের প্রতিটি স্তরে আদর্শ ও মূল্যবোধের অভাবের কারণে যুবসমাজে অবক্ষয় শুরু হয়েছে।
জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রভাব : সংস্কৃতি একটি দেশ ও জাতির পরিচয় বহন করে। কিন্তু সংস্কৃতি যখন অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয় তখন তা জাতির জন্য ধ্বংস ডেকে আনে । আর এই ধ্বংসের মুখে যুবসমাজ সবচেয়ে বেশি পতিত হয় । যুবসমাজের ওপর যেসব মাধ্যমে অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়ে সেগুলো হলো— বিদেশি সিনেমা, ডিস-অ্যান্টেনার মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান, নাটক, দেশি সিনেমার নোংরা কাহিনি, উচ্ছৃঙ্খল পোশাক-পরিচ্ছদ, অশ্লীল চরিত্র, পর্নো ছবি ইত্যাদি । তাছাড়া টেলিভিশনে কিছু অশ্লীল বিজ্ঞাপন দেখে যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে ৷
ছাত্র রাজনীতি : বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো চালিকাশক্তি ছাত্রসমাজ। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনীতির সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র । তথাকথিত রাজনীতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বই-খাতার আড়ালে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে । অস্ত্র হাতে বলীয়ান হয়ে ছাত্ররা নেতাদের ক্ষমতার বলে হত্যা, রাহাজানি, মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে । লেখাপড়ায় মনোযোগ না দিয়ে মিছিল, মিটিং, অনাচার দুর্নীতিতে মনোযোগী হচ্ছে । রাজনীতির ভয়ংকর কালো থাবা যুবসমাজকে নীতিভ্রষ্ট করে অবক্ষয়ের পথে ধাবিত করছে ।
পরিবর্তনশীল রাজনীতি : বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে । ঘনঘন ক্ষমতার পরিবর্তন যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ । একটি দল ক্ষমতায় এসে বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার ও অপশাসন শুরু করে । আবার বিরোধী দলও ক্ষমতার অপেক্ষায় থাকে, ক্ষমতা পেলে তারাও অত্যাচার ও অপশাসনের প্রতিশোধ নেয় । রাজনীতিক দলগুলো একে অপরের ওপর প্রতিশোধ নিলেও মাঝখান থেকে সাধারণ জনগণ ও তরুণদের ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কবলে পড়েও যুবসমাজ অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে ।
মাদকাসক্তি : মাদকদ্রব্য, মানবজীবন ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ । মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব । মাদকদ্রব্য যুবসমাজের নৈতিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের জন্য অনিবার্য অধঃপতনের পথ প্রশস্ত করে দেয় । প্রথমত তারা বিড়ি-সিগারেট দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে সর্বনাশা মদ, গাঁজা, আফিম, ভাং, হেরোইন, হাশিস, কোকেন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে । এসব মাদকদ্রব্য যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।
শিক্ষাঙ্গনে নকল ও সন্ত্রাসের প্রচলন : শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষায় পাশ করা যুবসমাজের অবক্ষয়ের একটি কারণ। নকল করে পরীক্ষায় পাশের পথ থাকায় ছাত্ররা লেখাপড়া না করে সারা বছর বখাটের মতো ঘুরে বেড়ায়, আর পরীক্ষার সময় নকল করে। নকল করতে বাধা দিলে পরীক্ষা কেন্দ্রে মারামারি করে, অস্ত্র হাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে । তাছাড়া কলেজে ভর্তির সমস্যা, বইয়ের সমস্যা, দেরিতে ক্লাস আরম্ভ করা, ফল প্রকাশে দেরি করা, যখন-তখন অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদি কারণে ছাত্রদের মানসিক বিপর্যয় ঘটে । ফলে যুবসমাজে অবক্ষয় ঘটে ।
সামাজিক পরিবেশ : একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড়ো অবদান রাখে তার পরিবার ও চারপাশের সমাজব্যবস্থা । একটি শিশু তার পরিবার ও চারপাশে যা কিছু দেখে তাই শেখে । আমাদের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। যেমন- রাজনীতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, আর্থিক অভাব, কাজকর্মে অবহেলা, মানুষে মানুষে ঝগড়া, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা, মিথ্যাচার, স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি । এসব অন্যায়-অনিয়ম দেখে যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বেকারত্ব : বেকারত্বের অভিশাপ যুবকদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ । শিক্ষার ত্রুটি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনীতিক প্রভাবের কারণে অনেক ভালো ছাত্র চাকরি পাচ্ছে না। অথচ খারাপ ছাত্ররা বড়ো বড়ো চাকরি পেয়ে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে ওঠে। ফলে অনেক শিক্ষিত যুবক হতাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কর্মহীন জীবনে মনের কষ্ট চাপা দিতে নানা প্রকার নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণ করছে, ছিনতাই করছে, সন্ত্রাসী চক্রের সাথে হাত মিলাচ্ছে। এতে যুবসমাজের অবক্ষয় ঘটছে।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের প্রতিকার : অবক্ষয়ের শিকার যুবসমাজকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। আর এ কর্তব্য পালন করতে হবে সমাজ ও দেশের জ্ঞানী-গুণী ও সচেতন ব্যক্তিদের। যুবসমাজের মনে সচেতনতার শিকড় গেড়ে দিতে হবে যাতে তারা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারে। যুবসমাজকে সচেতন করতে সকল জাতীয় প্রচার মাধ্যমকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । যেমন—'রেডিও, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। পরিবারের লোকজনদেরও তরুণদের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে, যেন তরুণরা অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে না পড়ে। তাছাড়া ছোটো থেকে ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা দিতে হবে ও ভালো কাজে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নিয়ে তাদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। যুবসমাজের মনোবল বৃদ্ধি করতে উৎসাহ দিতে হবে। যাতে তারা সব বাধা অতিক্রম করে অজেয়কে জয় করতে পারে, পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারে। তরুণদের উদ্দেশ্য করে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেনー
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত
আমরা টুটাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
আমাদের যুবসমাজকেও অন্ধকারের বুক চিরে আলোর পথের অভিযাত্রী হতে হবে; জাতীয় জীবনে সম্ভাবনার রাঙা প্রভাতের সূচনা করতে হবে ।
উপসংহার : তরুণরা রাতের অন্ধকার দূর করে প্রভাতের সূর্যকে স্বাগতম জানায়, পাহাড় সমান বাধা অতিক্রম করে বিজয় ছিনিয়ে আনে । অথচ এই তরুণরা পারিবারিক, সামাজিক, আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিকসহ নানা কারণে ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। তারা অবক্ষয়ের পথে গেলে দেশ ও জাতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে । তাই তরুণদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব । কবি সুকান্তের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদেরও বলতে হবে—