বাংলা রচনা : শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ভূমিকা

শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ভূমিকা

শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ভূমিকা
অথবা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও কম্পিউটার

[সংকেত: ভূমিকা; আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার কম্পিউটারের ভূমিকা; শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সরকারের ভূমিকা: উপসংহার ।]

ভূমিকা : আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো কম্পিউটার। বহুমুখী কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে এটি মানুষকে সেবা প্রদান করে থাকে। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কাজের গতি, বিশুদ্ধতা, নির্ভুলতা ও নির্ভরশীলতার দিক থেকে কম্পিউটারের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ও অনেক উন্নত। তাই বিশ শতকের শেষপ্রান্তে কম্পিউটার সর্বত্র স্থান দখল করে নিয়েছে। বিশেষত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় কম্পিউটারের ভূমিকা অপরিসীম। 

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কম্পিউটারের ভূমিকা : আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির অন্যতম বাহন হলো কম্পিউটার। শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহার করা আজকাল প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে । শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি পরিচালনা করতে শিক্ষক, ছাত্র সকলকেই কম্পিউটারের সাহায্য নিতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব ক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয় সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. শিক্ষা প্রদান : কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করার পদ্ধতিকে আনন্দদায়ক ও স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলা যায়। কম্পিউটারের সাহায্যে কোনো কাহিনি বা কার্টুন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যেকোনো পাঠকে আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলা যায় । যেকোনো কাহিনি পড়া বা শোনার চেয়ে তা নিয়ে তৈরি সিনেমা বা চলচ্চিত্র মনে অনেক বেশি রেখাপাত করে এবং তা দীর্ঘদিন মনেও থাকে। বর্তমানকালে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। এতে করে তারা বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং সেটি সহজে রপ্ত করতে সক্ষম হয় ।

২. শিক্ষা গ্রহণ : শিক্ষার্থীরা যদি কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তবে তা তাদের কাছে অধিক হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে । কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা যেকোনো সময়ে যেকোনো শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এতে করে শিক্ষা গ্রহণের বৈচিত্র্য আসে এবং শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তির সাথেও পরিচিত হতে পারে। বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, শ্রেণি উপস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা কম্পিউটারের সাহায্যে সব কাজ করতে পারে। যেমন- শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট হাতে না লিখে কম্পোজ করতে পারে এবং এর শুরুর পৃষ্ঠাটিতে নানা ধরনের নকশা করে সৌন্দর্য বর্ধন করতে পারে, শ্রেণি উপস্থাপনার বিষয়টিকে প্রাণবন্ত করে তুলে ধরতে কম্পিউটারের সাহায্যে বিভিন্ন বিষয় সংবলিত উৎস অংশবিশেষ আকারে অন্যদের দেখাতে পারে ইত্যাদি । এছাড়াও বর্তমান সময়ে যেকোনো শিক্ষা সংবলিত তথ্য পেন ড্রাইভে ধারণ করেও কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজ করছে শিক্ষার্থীরা।

৩. তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে কম্পিউটারের কোনো বিকল্প নেই। কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেকোনো শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্য নিমিষেই সংগ্রহ করা যায় এবং নিরাপদে সংরক্ষণও করা যায় । প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে দিন দিন কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণের অভিনব পন্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় এর উপযোগিতা ক্রমেই বেড়ে চলছে । তাই বর্তমানকালে শিক্ষার্থীরা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করছে এবং উপকৃত হচ্ছে। 

৪. শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে আইসিটি কার্যক্রম ও কম্পিউটারের ভূমিকা : বর্তমানকালে পরীক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো কাজ পুরোপুরি কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল । পরীক্ষার খাতা দেখা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ এসব কাজ যেন নির্ভুলভাবে সম্পাদন করা যায় সেজন্য কম্পিউটারের ওপরই নির্ভর করতে হয় । পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে আইসিটি কার্যক্রম ও কম্পিউটারের ভূমিকার কথা বলাই বাহুল্য । মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সহজ করার লক্ষ্যে Electronic Students Information Form (ESIF)-এর কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে । বর্তমানে অনলাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে এসএসসি, এইচএসসি, দাখিল, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ ও নিবন্ধন, পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ, এসএমএস-এর মাধ্যমে এবং ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের নিকট ৬০ দিনের মধ্যে প্রেরণ করা হচ্ছে। ব্যানবেইস কর্তৃক স্থাপিত Online data query এর মাধ্যমে Criteria ভিত্তিক শিক্ষা-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেশে ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতি কম্পিউটারের কার্যপদ্ধতির প্রতি আস্থা রেখেই চালু করা হয়েছে। পরীক্ষার সাথে সম্পর্কিত জটিল কাজগুলোও কম্পিউটারের বদৌলতে এখন অনেক সহজে করা সম্ভব।

৫. শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর্তি সংক্রান্ত কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার : শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহার করে অনলাইনের মাধ্যমে ফরম সংগ্রহ করে সহজেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া অনলাইনে শুরু করা হয়েছে। কেবল দেশের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরেও যদি কোনো শিক্ষার্থী লেখাপড়া করার উদ্দেশ্যে ভর্তি হতে ইচ্ছুক থাকে তবে কম্পিউটারের ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে ভর্তি হতে পারে ।

৬. শিক্ষা সম্পর্কিত কাজের যোগাযোগে কম্পিউটার : কম্পিউটারের মাধ্যমে যেকোনো শিক্ষার্থী যেকোনো জায়গায় শিক্ষা সম্পর্কিত কাজের উদ্দেশ্যে যোগাযোগ করতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থী সহজেই অন্যকোনো শিক্ষক,শিক্ষার্থী বা বিশ্বের কোনো অত্যাধুনিক লাইব্রেরির সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে । ফলে শিক্ষার্থী ঘরে বসেই তার প্রত্যাশিত তথ্য বা সংবাদ সংগ্রহ করতে পারছে । শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য বা বিষয় ই-মেইলের মাধ্যমে আদান- প্রদানও করতে পারে শিক্ষার্থীরা । এছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ফিচার ইত্যাদি নিমিষেই একজন শিক্ষার্থী নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে কম্পিউটারের কল্যাণে ।

৭. উচ্চশিক্ষায় কম্পিউটার : বর্তমানকালে শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ গমনের প্রবণতা লক্ষ করা যায় । এক্ষেত্রে কম্পিউটার বিশ্বস্ত এবং উপকারী বন্ধুর মতোই কাজ করে থাকে । বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ কিংবা যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে অনুসন্ধান করতে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় । ঘরে বসেই শিক্ষার্থীরা অনায়াসে এসব তথ্য সংগ্রহ করে উপকৃত হচ্ছে ।

৮. গবেষণার কাজে কম্পিউটার : শিক্ষামূলক যেকোনো গবেষণার কাজ পূর্বের তুলনায় এখন অনেক সহজ হয়েছে কম্পিউটারের কল্যাণে । বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, কৃষি, চিকিৎসা, ভাষা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য প্রতিটি দেশেই গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে । কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিস্তৃত তথ্য সবসময় এক জায়গায় পাওয়া যায় না । এ বিষয়ের সহজ সমাধান নিয়ে এসেছে কম্পিউটার । বর্তমানে বিষয়ের শিরোনামসহ প্রতিটি গবেষণামূলক প্রকাশনার সারসংক্ষেপ অল্প সময়েই অনুসন্ধান করা সম্ভব । এভাবে গবেষণার কাজকে স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করতে কম্পিউটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । 

৯. পুস্তক প্রকাশনায় কম্পিউটার : বর্তমানে কম্পিউটারের সাহায্যে পুস্তক প্রকাশনার কাজটি করা হয় বলে তা অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে । সিসার অক্ষর দিয়ে কম্পোজ করে হস্তচালিত লেটার প্রেসে যে বইটি প্রকাশ করতে এক বছর সময় লাগত তা এখন কম্পিউটারের কল্যাণে সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনে দুই-একদিনেই প্রকাশ করা যাচ্ছে। হাজার হাজার পৃষ্ঠা সংবলিত পুস্তক অনায়াসে কম্পিউটারের স্মৃতিতে রেখে দেওয়া যায় এবং পরে সুবিধামতো পুনঃমুদ্রণও করা যায় । কম্পিউটারের বদৌলতেই শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে পুস্তক হাতে পেয়ে যাচ্ছে এবং নির্বিঘ্নে লেখাপড়া করতে পারছে ।

১০. শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণে সহায়ক : যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয় । স্কুল-কলেজের বিভিন্ন প্রয়ে৷জনে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য যেমন— নাম, ঠিকানা, বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে । এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম্পিউটারে ফাইল খুলে শিক্ষার্থীদের পোর্টফোলিও তৈরি করে রাখে । এতে করে প্রয়োজনমতো এসব তথ্য খুঁজে পেতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সুবিধা হয় ।

শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সরকারের ভূমিকা : যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষাব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে । শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সরকারও নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে । দেশের প্রায় ১৩,৭০০টি মাধ্যমিক স্কুল, ৫,২০০টি মাদরাসা এবং ১,৬০০টি কলেজে একটি করে ল্যাপটপ, একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রদান এবং ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে । চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মাদরাসায় কম্পিউটার কোর্স চালু করা হয়েছে এবং প্রণীত কারিকুলামের মাধ্যমে কম্পিউটার শিক্ষাদান করা হচ্ছে। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে কম্পিউটারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে ।

উপসংহার : কম্পিউটারের অবদান সকল ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান যুগে শিক্ষাক্ষেত্রকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে কম্পিউটারের কোনো বিকল্প নেই । কম্পিউটারের বদৌলতেই শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদান প্রক্রিয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে । তাই শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটারের অবদান অপরিসীম।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url