কর্মমুখী শিক্ষা
অথবা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা
[সংকেত : ভূমিকা; কর্মমুখী শিক্ষা; অতীত দিনের কর্মমুখী শিক্ষা; কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ; বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা; কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা; কর্মমুখী শিক্ষার বর্তমান অবস্থা; কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে গৃহীত পদক্ষেপ; কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে করণীয়; উপসংহার।]
ভূমিকা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায় । শিক্ষা কুসংস্কার দূর করে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে । সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে শিক্ষা । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চিত্তের বিকাশ ঘটে । তবে শুধু চিত্তের বিকাশ ঘটালেই চলবে না, শিক্ষাকে অবশ্যই কর্মমুখী হতে হবে । সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষা সাধনাকে যদি জীবনের প্রয়োজনে কাজে লাগানো সম্ভব না হয় তাহলে শিক্ষার কোনো গুরুত্ব থাকে না । তাই আমাদের শিক্ষা এমন হতে হবে, যা দ্বারা সার্টিফিকেট অর্জনের পাশাপাশি জীবিকা উপার্জন করা যায় । তাই বর্তমান যুগে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ছে ।
কর্মমুখী শিক্ষা : কর্মমুখী শিক্ষা বলতে সেই শিক্ষাকে বোঝায়, যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে জীবিকা উপার্জনের যোগ্যতা অর্জন করে । আবার অন্যভাবে বলা যায়, জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা । শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি । কিন্তু বর্তমান যুগের শিক্ষাব্যবস্থা বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। তাই আমাদের দেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । আমাদের এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে কর্মমুখী শিক্ষা ।
অতীত দিনের কর্মমুখী শিক্ষা : অতীতকালে মানুষের ঝোঁক ছিল অর্থের প্রতি । তখন মানুষ অর্থ উপার্জনকে কেন্দ্র করে শিক্ষা গ্রহণ করত । তাই কর্মমুখী শিক্ষাই ছিল সেসময়ের আর্থিক নিশ্চয়তার উৎস । তাই সমাজ ছিল সতত কর্মমুখর । মানুষের উপার্জন ভালো ছিল বলে তাদের জীবন ছিল স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ । প্রতিটি পরিবারে ছিল আর্থিক সচ্ছলতা। কারণ সেসময় সকলেই পুরুষানুক্রমে অনুশীলনের মাধ্যমে গুণগত দক্ষতা লাভ করত । তখন প্রতিটি পরিবারই ছিল কর্মমুখী শিক্ষার এক অসামান্য প্রতিষ্ঠান । কর্মমুখী শিক্ষাই ছিল জীবিকা উপার্জনের অন্যতম পথ । কিন্তু কালে কালে এ শিক্ষার অবসান ঘটায় মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য এবং সমাজে নেমে আসে স্থবিরতা ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ : কর্মমুখী শিক্ষার নির্দিষ্ট কোনো প্রকার নেই । এই শিক্ষা নানা রকম হতে পারে । যেমন— বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল আর কেউবা শিক্ষাবিদ হয় । তাদের চাকরির আশায় বসে থাকতে হয় না । তারা স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত হয়ে স্বাধীনভাবে উপার্জন করতে পারে । বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চডিগ্রি অর্জন ছাড়াই সাধারণ কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করা যায় । এ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে উপার্জন নিয়ে কারও তেমন ভাবতে হয় না । যেমন— কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, দর্জির-কাজ, ছাপাখানার কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ, নার্সারি, বই বাঁধাই, বিদ্যুতের কাজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা : যতই দিন যাচ্ছে ততই সবকিছুতে পরিবর্তন হচ্ছে । যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষারও পরিবর্তন হচ্ছে । উন্নত হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি । আধুনিক বিশ্বে বেঁচে থাকার জন্য নানা কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে । অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে যাচ্ছে । সভ্যতা-সংস্কৃতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, জীবনযাত্রায় ক্রমেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের দেশের যুবকরা চাকরি পাচ্ছে না, পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারছে না । তাছাড়া মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, উপযুক্ত কারিগরি শিক্ষা নেই । ফলে শিক্ষার্থীদের একাংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারলেও বাকিরা মাঝপথে ঝরে পড়ে । আর শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে বেকার জীবনযাপন করে । বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মেধা, শ্রম ও সময়ের অপব্যবহার করে । ফলে দিন দিন বেকারত্বের সমস্যা বাড়ছে ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি । বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ শিক্ষাকে কাজে লাগানো যায় । একজন শিক্ষার্থী কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের পর তাকে আর চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না । সে স্বাধীন মতো কাজ করে অর্থ উপার্জন করে । এতে বেকারত্ব যেমন কমে তেমনি আর্থনীতিক সমস্যাও দূর হয় । বেকারত্ব আমাদের দেশের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ । কর্মমুখী শিক্ষা আমাদের দেশকে এ অভিশাপ হতে মুক্ত করতে পারে । দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে কর্মমুখী শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে । কর্মমুখী শিক্ষাকে কেন্দ্র করে একজন মানুষ সমৃদ্ধ জীবন ও উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে পারে । তাই আমাদের জীবনে কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য । আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও বাস্তব রূপায়ণ দরকার । এ শিক্ষার মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা এবং দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব । তাই কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম ।
কর্মমুখী শিক্ষার বর্তমান অবস্থা : কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা বেকার সমস্যা দূর করতে পারি । কিন্তু কর্মমুখী শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ আজও আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি । উন্নত দেশের অধিকাংশ মানুষ কারিগরি, প্রকৌশল, ভোকেশনাল ইত্যাদি শিক্ষায় শিক্ষিত । কিন্তু বাংলাদেশে এ শিক্ষার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই । অন্যান্য দেশে ৫-৬ শতাংশ জনগণ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত । সেই তুলনায় বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশেরও কম জনগণ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত । তাই আমাদের এ শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে গৃহীত পদক্ষেপ : আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে । কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি । আমাদের দেশে ক্রমেই কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশে এখন বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে, দেশ ও জাতির উন্নতি করতে আরও অনেকগুলো কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজন ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারে করণীয় : কর্মমুখী শিক্ষার জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আমাদের দেশে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য । তাছাড়া আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে । কিন্তু এ সম্পদ কাজে লাগানোর কৌশল আমাদের জানা নেই । সুতরাং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর কৌশল শিখতে তৎপর হতে হবে । তাছাড়াও চামড়া, সিরামিক, মৎস্য ও পোশাক শিল্পের উন্নতি করতে আমাদের যুবসমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
উপসংহার : যতই দিন যাচ্ছে ততই দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে । আর যতই জনসংখা বাড়ছে ততই আর্থনীতিক সংকট দেখা দিচ্ছে । এ সংকট দেশের জন্য চরম বিপদ । এ বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য দেশের যুব সমাজকে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে । এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট করতে হবে । প্রয়োজন অনুযায়ী আরও কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা আমাদের আর্থনীতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবো ।