ভাব-সম্প্রসারণ : নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস
ভাব-সম্প্রসারণ : মানুষ স্বভাবতই তার নিজের সুখ-সম্পদে পরিতৃপ্ত হতে পারে না। অপরিসীম আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সর্বদা তাড়িত করে। নিজের নয় বরং অন্যের সুখ ও ঐশ্বর্যকে বড়ো করে দেখে। তাই যে নিজের যতটুকু আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।
মানবজীবনে সুখ এবং সম্পদের প্রয়োজন আছে। এজন্যই তো মানুষ দিন-রাত্রি পরিশ্রম করে । তার পরিশ্রমেই তৈরি হয় ধন- সম্পদের পাহাড়। কিন্তু এত কিছু থাকার পরেও ওই মানুষ অন্যের সম্পদ দেখে অন্যকে তার নিজের চেয়ে অধিক সুখী মনে করে অতৃপ্তিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অন্যের সুখটাই তার কাছে বড়ো হয়ে ধরা পড়ে। মনোবিজ্ঞানীরা মানবচরিত্রের এ বিষয়টি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে দেখা যায়, মানুষের মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাশা অনেক সময় জন্ম দিতে পারে প্রচণ্ড হতাশার। মানুষ এভাবেই অতৃপ্তিতে ভোগে। আবার বাস্তবতার চরম আঘাতে অনেক সময় গগনচুম্বি উচ্চাশা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এসব মিলেই মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেয় অশান্তি আর অপ্রাপ্তি। পৃথিবীতে ধনী-নির্ধন সকলেই আজ এরূপ অতৃপ্তির শিকার। এ ধরনের অতৃপ্তি জন্ম দেয় চৌর্যবৃত্তি, হানাহানিসহ নানা ধরনের অপকর্মের। সমাজ সংসারে আজ যেন সুখের বড়ো অভাব। তাইতো জীবনের এই সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যথার্থ বলেছেন যে, অজস্র ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও কেউ যদি নিজেকে অসুখী মনে করে তাহলে সে অসুখী, আবার সর্বস্বহীন মানুষ নিজেকে সুখী মনে করলে সে সুখী। অর্থাৎ সুখ-দুঃখ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। প্রবহমান নদীর দুই পাড়ে যদিও সমান সুখ-সুবিধা ও অসুবিধা আছে তবুও এপাড়ের মানুষ অন্য পাড়ের মানুষকে অধিক সুখী মনে করে নিজেকে ছোটো করে। তাদের হৃদয়ে ওপারের সুখটাই বড়ো হয়ে ধরা দেয়। মাত্রাতিরিক্ত সুখ আর বিলাসের প্রতিযোগিতায় মানুষ নিজের প্রতি ক্রমেই তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এ বিশ্বায়নের যুগে মানুষ শুধু ধন-সম্পদ আর সুখ খুঁজে বেড়ায়। না পাওয়ার চরম বেদনা নিয়ে সুখ নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু এর শেষ কোথায়— তা হয়ত জানা যায় না। তদুপরি মনীষীরা মানুষের এ অতৃপ্তি পরিহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ক্যালভিন ওরেনের উক্তিটি স্মরণযোগ্য— ‘মানবজীবন চিরদিন সুখ-শান্তিতে কাটে না। আকাশের দিকে হাত বাড়ালে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই মিলে না। চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডি তাই মাটির কাছাকাছি হওয়া ভালো।
মানবজীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। অবিরাম এর গতি। তাই সীমাহীন অতৃপ্তি জন্ম দিতে পারে চরম হতাশা। সুতরাং নিজের যতটুকু আছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার মধ্যে আছে মানবমনের পরম তৃপ্তি ও আনন্দ।