বাংলা রচনা : ইদ উৎসব
ইদ উৎসব
ভূমিকা : পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রতিটি জাতি নিজ নিজ ধর্ম বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। প্রত্যেকের জীবনে নিজ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন না কোন ধর্মীয় উৎসব থাকে। মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার অধিকারী ধর্মীয় উৎসব হল ইদ উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলমানদের নিকট ইদ হল শ্রেষ্ঠ ও জাতীয় উৎসব।
মুসলমানদের ইদ উৎসব দুটি : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। রমজান মাসে রােজা বা সিয়াম ব্রত পালন করার পর আসে ঈদুল ফিতর আর জিলহজ মাসের দশ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। এই দুই ইদে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
ঈদুল ফিতর : শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। ‘ইদ’ আরবি শব্দ, অর্থ ‘আনন্দ। রমজান মাসে দীর্ঘ সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের আনন্দের দিন ঈদুল ফিতর। এর আগের ২৯ বা ৩০ দিন মুসলমানেরা সংযমের মধ্যে দিয়ে রােজা রাখেন। দীর্ঘ এক মাস কঠোর সংযমের পর শাওয়ালের নতুন চাঁদ মুসলমান আবাল-বৃদ্ধ-বানতাম তুদয়ে এক স্বর্গীয় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। সকল বয়সের নারী পুরুষ ইদের চাঁদ দেখে অভূতপূর্ব আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন। রমজান মাসে মুসলমানেরা সুবেহ সাদেক থেকে পরবর্তী সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার করেন না। রমজান মাস সমাপ্ত হলে পরদিন সকলে মিলে আনন্দ উৎসব উদ্যাপন করেন। এদিন সকালে ইদগাহ মাঠে পুরুষদের ইদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজের আগে ধর্ম প্রাণ মুসলমানেরা দরিদ্রদের মধ্যে ‘ফিতরা’ নামে ‘দান’ বিতরণ করেন।
ঈদুল আযহা : ঈদুল আযহা বিশ্বের মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবের সঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের এক পবিত্র ঘটনা সম্পর্কিত। “ঈদুল আযহা’ শব্দটিও আরবি, অর্থ ‘উৎসর্গের আনন্দ-উৎসব’। হযরত ইবরাহিম (আ) সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন। হযরত ইবরাহিম (আ) সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে নিজের আদরের ইসমাইলকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানী দিতে তৈরি হলেন। প্রিয় নবী দ্বিধাহীন চিত্তে পুত্রের গলায় ছুরি চালনা করতে যাবেন এমন সময় দৈববাণী হল যে, তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং পুত্রকে আর কোরবানী দিতে হবে না। আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে সেখানে দৈববলে আনীত একটি দুম্বা হযরত ইবরাহীম কোরবানী করেন। এই পবিত্র ঘটনা স্মরণ করে মুসলমানেরা প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহর নামে পশু কোরবানী করেন। কোরবানীর লক্ষ্যে, উট, দুম্বা, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া-এসব পশুর যে কোন এক জাতের একটি পশু জবেহ করা হয়। এ কোরবানীর পশুর মাংস মুসলমানেরা নিজে খান এবং আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এটিই ঈদুল আযহার উৎসব উদযাপন।
ইদ উৎসবের
তাৎপর্য : ইদ উৎসব মুসলমানদের কেবল ধর্ম পালনের আনুষ্ঠানিকতা বা আনন্দের উৎসব নয়। এর অন্তর্নিহিত বিশেষ তাৎপর্য আছে। ইসলাম শান্তি ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম ত্যাগের ধর্ম। সকল মানুষের মিলনের বাণী। ধনী-দরিদ্রের সাম্যের বাণী এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। ইসলামে হিংসা-দ্বেষের স্থান নেই; সকল মুসলিম ভাই ভাই এই অমােঘ বাণী ঘােষিত হয় ইদ উৎসবের মাধ্যমে। ইসলামে ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই, একই সঙ্গে একই কাতারে সবাই নামাজ আদায় করেন। ঐক্যের, সাম্যের, সম্প্রীতির মহান নীতি ইদ উৎসবের মধ্যে প্রতিফলিত। ইসলামে ইদ কেবল নিজের আনন্দ লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সকল মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় যে আনন্দ, সেটাই প্ৰকত আনন্দ। যাকাত-ফিতরা বিতরণের মাধ্যমে গরিবদের সাহায্য করা হয়। ইদ উৎসব পালনের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সাম্যের পবিত্র বাণীই প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে।
ইদ উৎসবের
আনন্দ : সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঘরে ইদ আসে আনন্দের পসরা নিয়ে। ইদের দিন সকালে ছেলে-বুড়ো সবাই নতুন নতুন জামা কাপড় পরিধান করে দলে দলে ইদগাহের মাঠে গিয়ে সমবেত হয়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সবাই নামাজ আদায় করে। ধনী-দরিদ সবাই পরস্পর কোলাকুলি করে। ঈদুল ফিতরের দিন সেমাই-ফিরনি হয়, বিরানী পােলাও হয়। আতীয়-স্বজনের বাড়ি বাড়ি ঘরে সবাই ভাল ভাল খাবার খায়। ঈদুল আযহার দিন সকালে ইদের নামাজের পর কোরবানীর পশু জবাই করা হয়। নিজেদের জন্য মাংস রেখে বাকিটা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। দুপুরের দিকে মাংস রান্না হয়ে গেলে সকলে মিলে আনন্দ করে রুটি মাংস খায়।
উপসংহার : মুসলমানদের ইদ উৎসব আনন্দের, সাম্যের, সহানুভূতির বাণী প্রচার করে। ইদ মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন তৈরি করে। ইদের আনন্দের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সষ্টি হয়। ইদের অনুশাসনের ভেতর দিয়ে মানুষে মানুষে যে ভালােবাসার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতি আন্তরিক হয়ে ইদ উৎসব পালন করা উচিত। পদের তাপ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারলেই ইদ উৎসব উদ্যাপন সার্থক হবে।