বাংলা রচনা : দারিদ্র্য বিমোচনে নারীসমাজের ভূমিকা
দারিদ্র্য বিমোচনে নারী সমাজের ভূমিকা
[সংকেত : ভূমিকা; নারীসমাজের ওপর দারিদ্র্যের প্রভাব; দারিদ্র্য বিমােচনে নারীর ভূমিকা; নারীর পরিশ্রমের অবমূল্যায়ন; দারিদ্র্য বিমােচনে নারীকে সক্রিয় রাখতে সরকারি-বেসরকারি ভূমিকা; উপসংহার।]
ভূমিকা : যে কোনাে দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণের জন্য নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য । বর্তমান সময়ে নারীর স্বতন্ত্র সত্তা সর্বজনস্বীকৃত। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন দেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ ? করছে নারীরা। আজ সর্বত্র নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য বিমােচনেও নারী প্রত্যক্ষ । ভূমিকা রাখছে। অতীতে নারীর অসহায় প্রতিচ্ছবি সময়ের ব্যবধানে এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এখন নারী স্বাবলম্বী। প্রতিটি । ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধনে ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সমাজের অর্ধেক জনগােষ্ঠী। তথা নারীদের পিছনে রেখে একটি জাতির পক্ষে কখনাে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানাে সম্ভব নয়। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল─
বিশ্বে-যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নারীসমাজের ওপর দারিদ্রের প্রভাব : বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল দেশগুলােতে দরিদ্র জনগােষ্ঠীর অধিকাংশই নারী। ২০১৫ সালের আর্থনীতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২৪.৮%। বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৯২ লাখ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ২ কোটি ৪ লাখ। নারী, ভূমিহীন ও আদিবাসী মানুষ এই চরম দারিদ্র্যের শিকার। নারী ও পুরুষ উভয়েই এই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করলেও পুরুষের তুলনায় নারী দারিদ্র্যের বােঝা বহন করে বেশি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীরাই মূলত দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘরের ভিতরে নারী যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবােধ নারীর আর্থনীতিক মুক্তি ও ক্ষমতায়নের পথে। সবচেয়ে বড়াে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। নারী যেন কোনােভাবেই স্বাবলম্বী হতে না পারে সেজন্য নারীকে আত্মনির্ভর হওয়ার শিক্ষা এবং পছন্দসই কোনাে পেশা বেছে নিতে দেওয়া হয় না। নারীকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য কোনাে মূল্যবােধ তৈরি করা হয় না।দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত মূল্যবােধ নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। এতে করে নারী তার অধিকার, মর্যাদা, সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। আবার, নারী যখনই পুরুষের সব ধরনের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজে কিছু করতে চায় তখনই নানা ফতােয়ার মাধ্যমে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বিশেষত গ্রাম-বাংলার নারীরা যখন আর্থনীতিক মুক্তির জন্য লড়াই করে তখন নানারকম ফতােয়া দিয়ে তাদের নির্যাতন করা হয় এবং তার আর্থনীতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দেয়। অপরদিকে, বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি নারীর অবস্থাকে ক্রমাগত অবনত করছে। একদিকে বাজারে নারী তার স্বল্প দক্ষতা ও পুঁজি নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না এবং অন্যদিকে দারিদ্র্যের কারণে পুরুষরা পরিবার ত্যাগ করে শহরমুখী হওয়ায় নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এসব পরিবার অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ফলে দারিদ্র্যের চাপ নারীদেরকেই বেশি নিতে হয়। আমাদের দরিদ্র নারী জনগােষ্ঠীর একটি বড়াে অংশ স্বামী নিগৃহীত, পরিত্যক্ত ও তালাকপ্রাপ্তদের নিয়ে গঠিত। এদের যে আলাদা কোনাে ব্যক্তিসত্তা আছে, নিজস্ব কোনাে সম্ভাবনা আছে সে রকম ধারণা সৃষ্টি করে দিতে সমাজ নারাজ। অথচ সাংসারিক নানা কাজকর্মে নারী যে দক্ষতা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দেয় সে দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে অনায়াসেই অর্থ উপার্জনের কাজে লাগানাে যায় । কিন্তু তাদের সে সুযােগ দেওয়া হয় না, বরং তৈরি করা হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে নারীরাই দারিদ্র্যের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।
দারিদ্র বিমােচনে নারীর ভূমিকা : দারিদ্র্য ধারণাটির উদ্ভব হয় বঞ্চনা থেকে। উন্নয়নশীল দেশগুলােতে দারিদ্রকে চরম বঞ্চনার সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হয়, যা জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশকে দারিদ্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দারিদ্র্য বিমােচনে নারীর অংশগ্রহণকেই নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, এদেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠীই নারী। কোনাে দেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠীই যদি অনগ্রসর থাকে তবে সে দেশের উন্নয়ন সাধন করা কখনােই সম্ভব নয়। গত এক দশকে বাংলাদেশের দারিদ্র্য প্রায় অর্ধেক কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন । বিশ্লেষকরা মনে করেন, দারিদ্র বিমােচনের ক্ষেত্রে নারীদের একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামের নারীরা এখন অনেক সচেতন। তারা আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী। হচ্ছে। পশুপালন থেকে শুরু করে ধানের চাতালেরও মালিক হচ্ছেন তারা। সরকারের গৃহীত নানা কর্মসূচির মাধ্যমে অনেক নারী। বাড়তি উপার্জন করে সংসারে সচ্ছলতা আনতে সক্ষম হচ্ছে। শ্রমবাজারের প্রেক্ষিতেও নারীর অবস্থানের উল্লেখযােগ্য উন্নতি লক্ষ করা যায়। নারী ও পুরুষ মিলে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ জনগােষ্ঠী কোনাে না কোনাে কাজের সাথে জড়িত। কর্মজীবী পুরুষের। তুলনায় কর্মজীবী নারী তিনগুণ বেশি কাজ করে। এমন কোনাে ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী কর্মজীবী নেই। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বৈজ্ঞানিক, বৈমানিক, পুলিশ, আনসার, ব্যাংক-বিমা, জনপ্রশাসন, নির্মাণশিল্প ইত্যাদি শাখা মিলে প্রায় এক কোটি নারী প্রধান নির্বাহী, শীর্ষ নির্বাহী, উচ্চপদের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পদ পর্যন্ত নিয়ােজিত আছে। গণমাধ্যম ও শিল্পীর পেশাকেও বেছে। নিচ্ছেন নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় তারা। আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী। তারা কাজের জন্য বেতন ও মজুরি পাচ্ছেন এবং মূল্য সংযােজন অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে দারিদ্র্য বিনে ভমিকা রাখছেন। এমনকি কৃষিক্ষেত্রেও নারীর অবদান চোখে পড়ার মতাে। পানিসেচ, চারা রােপণ, যন্ত্রে ধান-মাড়াই, আ৯. সসল পরিচর্যা ইত্যাদি কাজে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ সমান সমান । আবার, সিদ্ধ-শুকানাের পুরাে কাজই পরিচালনা করে। নারী । এভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে নারীর অবদান বাড়ছে এবং দারিদ্র্য বিমােচনে তাদের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে ।
নারীর পরিশ্রমের অবমূল্যায়ন : দারিদ্র্য বিমােচনে নানামুখী অবদান রাখা সত্ত্বেও নারীর পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। এখনও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের অবস্থান অনেকটাই পেছনে। শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৩ অনুযায়ী কাজে নিয়ােজিত নারীর ৩৭ শতাংশ মজুরি ও বেতনভিত্তিক কাজে জড়িত এবং ১২ শতাংশ স্বনিয়ােজিত কাজে নিয়ােজিত। এরা মূলত পারিবারিক শ্রমিক, যারা তাদের স্বামী বা শ্বশুরের জমি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে নিয়ােজিত। অর্থাৎ, তারা শ্রমবাজারে গণনায় এলেও এবং তাদের উৎপাদিত সামগ্রী জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের শ্রমের বিনিময়ে তারা কোনাে পারিশ্রমিক পান না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের সুবিধা ভােগ করে পুরুষ এবং তা পরিশােধ করে নারী । মােট দেশীয় উৎপাদনে নারীর অবদান আছে ঠিকই তবে সন্তান লালন-পালন এবং গৃহস্থালি কাজকর্মের স্বীকৃতি নারী এখনও পায়নি। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমান নির্ধারিত হয়নি। অর্থনীতিতে নারীর এ অবদান আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কোনাে কোনাে । জায়গায় নারীর মজুরি হার এখনও পুরুষের তুলনায় কম। অর্থাৎ দেখা যায়, নারীর পরিশ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন এখনও হচ্ছে না।
দারিদ্র্য বিমােচনে নারীকে সক্রিয় রাখতে সরকারি-বেসরকারি ভূমিকা : নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বর্তমান সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। সকল উন্নয়নমূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন। কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা বা ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা চালু করেছে। এছাড়া বয়স্কভাতা, বিধবা-তালাকপ্রাপ্ত ও নির্যাতিত নারীদের ভাতা কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে। এছাড়া নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশিক্ষণ প্রদান করে, ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্য বিমােচনে নারীদের সক্রিয়ভাবে। অংশগ্রহণের সুযােগ করে দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাে। গ্রামীণ সমাজে নারীদের নিয়ে প্রচলিত সংকীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন সাধনেও ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি সংস্থাগুলাের সচেতনামূলক কার্যক্রম। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে মহিলাদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তারা মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন । এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করে থাকেন। অর্থাৎ, সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ দারিদ্র্য বিমােচনে নারীকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করছে।
উপসংহার : একটি দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড়াে প্রতিবন্ধক হলাে দারিদ্র। এ দারিদ্রের যারা সবচেয়ে বড়াে শিকার এবং পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণে যারা সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার সেই নারীকে আর্থনীতিক কর্মকাণ্ড এবং ক্ষমতায়ন থেকে দূরে রাখলে কখনাে দারিদ্র বিমােচন করা সম্ভব নয়। তাই দারিদ্র্য বিমােচন কার্যক্রমকে সফল করার জন্য নারীর ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর চরণদ্বয়কে মনে রাখা কর্তব্য ─
কোনকালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।