দেশভ্রমণ
ভূমিকা : জন্মসূত্রেই মানুষ কৌতূহলী প্রাণী। তাই অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার আগ্রহ মানুষের চিরকালের। পরিচিত গণ্ডির বাইরে তার মনে ভিড় করে দূর অজানার নানা আকর্ষণ, যেখানে গেলে তার আনন্দ হবে, চিত্তের মুক্তি ঘটবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখেছেন ー
‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী-গিরি সিন্ধু মরু
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগােচরে।'
কোথাও নদী-নিঝর, কোথাও গিরি-পর্বত, সবুজ অরণ্য, মরুভূমির ধূসর বালি, কোথাও বরফে ঢাকা সব — এ সবই মানুষের জন্য এক অদ্ভুত আকর্ষণ। এ আকর্ষণই মানুষকে টানে দেশভ্রমণে।
দেশভ্রমণের ইতিহাস ও শিক্ষা : আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আগে, প্রাচীনকালে ভ্রমণ ছিল শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। সেকালে মানুষ জ্ঞান আহরণের প্রয়ােজনে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন। বিখ্যাত পর্যটকদের কথা আমরা জানি—চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, আরব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার—এঁরা সবাই ভারতবর্ষ ভ্রমণে এসেছিলেন। তাঁদের অনেকেই ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছেন। সেসব বৃত্তান্তে ইতিহাসের অনেক তথ্য জানা যায়। প্রাচীনকালে যােগাযােগব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। তবু পরিব্রাজকরা হাজার প্রতিকূলতা অক্রিম করে দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন, অজানাকে জানার প্রয়ােজনে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে রেখেছেন। তাঁদের পদচিহ্ন। আধুনিক যুগে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা দেশভ্রমণকে একেবারে সহজসাধ্য করে দিয়েছে। এখন আমরা খুব সহজে, অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারি।
শিক্ষা ও আনন্দের জন্য ভ্রমণ : ভ্রমণ মানুষের মনে নিয়ে আসে নতুন আনন্দের বন্যা। বাইরে প্রসারিত পৃথিবী, তার বিচিত্র নৈসর্গিক শােভা, মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন দেখে মন একটা ভিন্নতার স্বাদ পায় । শুষ্ক মন সজীব হয়ে ওঠে। সংসারের সীমাবদ্ধ জীবন আর দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার মাঝে মন হাঁফিয়ে ওঠে। ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতায় মানুষ হারিয়ে ফেলে মনের ঐশ্বর্য। বিরূপ বাস্তবতার কারণে অনেক সময় মানুষের মন রুক্ষ, বিতৃষ্ণ হয়ে উঠতে পারে। ভ্রমণ মানুষকে এসব থেকে মুক্তি দিতে পারে, দিতে পারে প্রয়ােজনীয় শুশ্রুষা। দেশভ্রমণে ক্ষুদ্রের সঙ্গে বৃহতের যােগাযােগ ঘটায় বলে ভ্রমণ শুধু নিছক আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। বহির্বিশ্বকে নিজের চোখে দেখে যে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, প্রাচীরঘেরা বিদ্যায়তনে তা অনেক সময় অর্জন করা সম্ভব হয় না। দেশভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের অধীত বিদ্যা পূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন : ইতিহাস, ভূগােল এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের বইতে এমন অনেক ঐতিহাসিক স্থানের উল্লেখ আছে, সেগুলি যদি নিজ চোখে দেখি, তখন প্রাচীন ইতিহাস আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেজন্য আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষামূলক ভ্রমণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তা ছাড়া একটা নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকলে মানুষের হৃদয় ও মন সংকুচিত হয়ে যায়। চিত্তের স্বাভাবিক প্রসারতা ব্যাহত হয়। দেশভ্রমণের আনন্দই মানুষকে এসব সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। বৃহত্তর জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলে মুছে যায় মনের সব ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা। দেশভ্রমণ মনের বন্ধ দরজাগুলাে খুলে দিয়ে চেতনার নতুন আলাে ছড়ায় প্রাণে । রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন ー
'আমি চঞ্চল হে ।
আমি সুদূরের পিয়াসী।'মানুষের দূরাচারী কল্পনাই তাকে দেশান্তরের পথে টেনে নিয়ে যায়। কেউ বের হয় আবিষ্কারের নেশায়, কেউ তীর্থ দর্শনের পূর্ণ বাসনায়। নিছক আনন্দের জন্যেও কেউ কেউ দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। আজকাল শিক্ষা এবং বাণিজ্যের জন্য মানুষ দেশান্তরের অভিযাত্রী হয়। উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভ্রমণ মানুষকে আনন্দ দেয়, অন্তরকে উদার করে, জ্ঞানকে করে প্রসারিত।
উপসংহার : ভ্রমণ মানুষের স্বভাবসিদ্ধ। সুদূরের আকর্ষণে মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই দেশান্তরের অভিযাত্রী হয়েছে। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার দুর্বার আকর্ষণে ছুটে গেছে বিপুলা পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এ ভ্রমণ মানুষকে যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে মানুষ। দেশভ্রমণের মাধ্যমে। দেশভ্রমণের তীব্র বাসনাই প্রকাশ পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প কবিতায়ー
‘থাকব না ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগক্টাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।'