বাংলা রচনা : বনভােজনে একদিন

বনভােজনে একদিন

বনভােজনে একদিন 

মানুষ যখন নিত্যদিনের ছকবাঁধা জীবন-যাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন স্বভাবতই সে চায় একটু আনন্দ-ফুর্তি। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি এবং আনন্দ উপভােগের একটি সুন্দর ব্যবস্থা হচ্ছে বনভোেজন। নিছক আনন্দ পারে উদ্দেশ্যে কোথাও ভ্রমণ করতে গিয়ে যে ভােজন করা হয় তাকে বনভােজন বলা  যেতে পারে। এতে রয়েছে ভিন্ন স্বাদ, নির্মল আনন্দ। 

বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা সবাই মিলে বনভােজনে যাওয়ার চিন্তা করলাম। সবাই গিয়ে একদিন আমাদের স্কুলের . প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি বললাম। অনেক অনুরােধের পর আমাদের শিক্ষকবৃন্দ রাজি হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যাব কোন দিন যাব সব ঠিক হলাে। 

শুরু হয়ে গেল প্রবল উৎসাহে প্ৰস্তুতি। সবাই চাঁদা দিলাম ১০০ টাকা করে। বাকি টাকা স্কুল ফান্ড থেকে দেওয়া হবে। বনভােজনে যাওয়ার আর মাত্র দুদিন বাকি। আমরা বন্ধু-বান্ধব সবাই প্রস্তুত। আমার অনেক দিনের বন্ধু টিংকুর গেল দুদিন ধরে খোজ নেই। বাসায় গেলাম খোঁজ নিতে। শুনলাম দু দিন হয় সে জ্বরে ভুগছে। মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। টিংকুকে সান্ত্বনা জানিয়ে মনমরা হয়ে বাসায় ফিরলাম। বনভােজনের পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে সবাই একরকম হইচই জুড়ে দিয়েছে। টিংকু সঙ্গে যাবে না ভেবে আমি কোনাে উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। বনভােজনের দিনটি যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলাে সবার মধ্যে উত্তেজনা তততা বেড়েই চললাে। এরই মধ্যে স্কুল মাঠে সবাই মিলেছে। অনেকেই কাগজের ফুল, রঙিন কাপড়ের ব্যাজ ফেস্টুন এসব তৈরি নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে বনভােজনের স্লোগানের কসরত করছে। একদল চিৎকার করে বলছে : যাচ্ছি কোথায়, যাচ্ছি কোথায়? অন্যরা বলছে ময়নামতী, ময়নামতী।

কেউ আবার কী গান গাইর, কে নাচবে, অনঠান করবে এসব নিয়ে হই হাড়ি করছে। কেউ কেউ আপত্তি তুলেছে যেকোন গান হবে না, ওয়াকম্যান, ভিডিও গেম ইত্যাদি আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব। কার ক্যামেরা আছে, ফটা চামেয়া যাবে, কে ভালাে ছবি তুলতে পারে ইত্যাদি। মনে হচ্ছে আজই বুৰি বনভােজন হয়ে যাচ্ছে। বাস ভাড়া থেকে শুরু করে সবই বতুত হয়ে গেছে। নানা পরিকল্পনা শেষে সবাই বাসায় ফিরল। কাল সবাই তাের সাতটায় স্কুল মাঠে হাজির হতে বলা হয়েছে। 

বনভােজনে যাওয়ার সময় এল। শুধু রাতটা বাকি। তাের হতে না হতেই মা ছােট্ট একটা ব্যাগে টুকটাক শীতের কাপড়চোপড় ও ভােয়ালে এসব দিয়ে আমার কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে দিলেন। সঙ্গে একপ্যাকেট বিকিট দিয়েছেন, পথে খাওয়ার জন্য। আমি হেসে বললাম মা ওরা সব খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বাড়ি থেকে কিছুই নিতে হবে না। এমন সময় টিকুর গলা শুনতে পেলাম। টিংকু একরকম চিৎকার করে আমাকে ডাকছে। আমি আর মাকে কিছু বলার সুযােগ পেলাম না। অমনি দৌড়ে এলাম। টিংকু পুরােপুরি সুস্থ হতে না পারলেও জ্বর নেই। টিকুর বাবা-মা তাকে দেখেশুনে রাখতে বললেন। টিংকুকে কাছে পেয়ে আমার কী যে আনন্দ, তা বলে বােঝানাে যাবে না। 

নির্দিষ্ট দিনে তাের ৭টায় পরিকল্পনা মতে সবাই স্কুল মাঠে উপস্থিত হলাম। আমরা মােট ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং আমাদের সব শিক্ষক আমাদের সঙ্গে গেলেন। রান্নার জন্য দুজন বাবুর্চি ও স্কুলের একজন বেয়ারাকেও সঙ্গে নেওয়া হলাে। সকাল ৮টায় ময়নামতীর উদ্দেশ্যে আমাদের বাস ছেড়ে দিল। হালকা কুয়াশা ভেদ করে সােনা রােদ উঁকি দিচ্ছে। বাতাসে উড়ছে আমাদের ব্যানার নিশান, আমাদের চুল, জামা, আমাদের মন-প্রাণ। দু পাশের গাছপালা, ঘরবাড়ি, ছায়াছবির মতাে মিলিয়ে যেতে লাগল। পথেই একটা নিরিবিলি জায়গায় বাস থামিয়ে নাশতার পর্ব শেষ করা হলাে। হেড স্যার প্রথমেই সবাইকে সাবধান করে দিলেন এখানে কোনাে হইচই না করার জন্য। প্রথমে সবাই আমরা চুপই ছিলাম, এরই মধ্যে দু-একজন গুনগুনিয়ে গান গেয়ে এবং কৌতুক বলে হাসির রােল তুলল। অনেকেই হাসি চাপাতে গিয়ে তা পরিণত হলাে অট্টহাসিতে। হাসির কারণ না জেনেই সবাই যােগ দিয়েছে হাসিতে। স্যারও আর তেমন কিছু বললেন না। হাসাহাসির মধ্য দিয়ে নাস্তার পর্ব বেশ ভালােই জমে উঠেছিল। তারপর আবার সবাই বাসে চড়লাম। মাত্র দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের বাস ময়নামতী গিয়ে পৌছল। একটু এগিয়ে শালবন বিহার বয়ে রেখে আমরা শালবনের পাশে গাড়ি থামালাম। একটা গাছের তলায় পাটি ও চাদর বিছানাে হলাে। পাশেই রান্নার ব্যথা হলো।

আমরা সবাই মিলে চলে গেলাম শালবন বিহার দেখতে। জায়গাটা প্রথমে দেখতে ভাল লাগছিল না কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে এখানকার পুরাকীর্তি ও সভ্যতা এবং জাদুঘর সম্পর্কে জানতে পেরে আনন্দে মনটা ভরে উঠল। এখানে রয়েছে অনেক পুরােনাে ঐতিহাসিক নিদর্শন, লালমাই, পাহাড়, শালবন বিহারসহ ক্যান্টনমেন্ট বাের্ড, বার্ডসহ আরও অনেক জানার ও দেখার জিনিস। শিক্ষকবৃন্দ আমাদের সঙ্গে নিয়ে সব কিছু দেখান এবং প্রতিটি জিনিসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝিয়ে দেন। এককালে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা লেখাপড়া ও ধর্মচর্চা করতেন। সেই পুরােনাে আমলের ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে গর্ব হলাে, শতশত বছর আগের ঐতিহ্য আমরা বয়ে চলেছি। রকিবের হাতে ছিল ক্যামেরা। সে ঝটপট অনেকগুলাে ছবি তুলে নিল। আমি ও টিংকু একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এরপর গেলাম জাদুঘরে। এখানে। সে আমলের নানা নিদর্শন সাজানাে রয়েছে। প্রাচীনকালের হাতিয়ার, তাম্রলিপি, মুদ্রা, অলঙ্কার, ব্রোঞ্জের মূর্তি, পােড়ামাটির চিত্রফলক ইত্যাদি দেখে অবাক হলাম। সবকিছু দেখতে দেখতে ও জানতে জানতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। আমরা বনভােজনের স্থানে ফিরে গেলাম। পৌছে দেখি বাবুর্চিদের মধ্যে কী নিয়ে যেন হট্টগােল চলছে। খোঁজ নিয়ে জানাগেল রান্না বসাতেই দেরি হয়ে গেছে। রান্না শেষ হতে এখন খানিকটা সময় লাগবে। মনে মনে আমরা খুশিই হলাম। বেশ তাে সবাই গােলবেঁধে বসে শুরু হয়ে গেল নাচ-গান। কখন যে সময় গেল কেউ বুঝতেই পারল না। এর মধ্যে চলে এল খাওয়া। সবজি, ইলিশ মাছ ভাজা, ডিম ফ্রাই আর মুরগির মাংস। দেরি হলেও রান্না বেশ। ভালাে হয়েছে। ইতােমধ্যে অনেকেই আহা! ওহ! এর মধ্য দিয়ে রান্নার তারিফ করতে লাগলাে। বাবুর্চি জোর গলায় ঘােষণা করল, “স্যার আমাগাে বকশিশ একহাজার টেহা বাড়াইয়া দিয়েন। মৃদু গলায় কে একজন বলে উঠল, খাওয়া খারাপ হয়েছে বললে কী এক হাজার কম? অমনি হাসাহাসির রােল পড়ে গেল। খাওয়ার স্বাদ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সব মিলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য মহা আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

ভ্রমণ, ভােজন, সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ফেরার পালা। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। খুব ব্যস্ততার মধ্যে সবাই গাড়িতে যার যার জায়গা দখল করে বসলাম। আমাদের স্কুলের মাঠে আসতে রাত ৮টা বেজেছিল। যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। এমন একটি বনভােজনের স্মৃতি আমার মনে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url