বাংলা রচনা : নারী শিক্ষা
নারী শিক্ষা
ভূমিকা : একুশ শতকে পদার্পণ করে বর্তমান বিশ্ব যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে, নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার । কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকারে পিছিয়ে পড়া নারীর পক্ষে সেই প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। তাই আজ দাবি উঠেছে ব্যাপক নারীশিক্ষার।
নারীশিক্ষার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : এককালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ছিল প্রাধান্য। তাই প্রাচীন হিন্দুবৌদ্ধ সাহিত্যে শিক্ষিত নারীর দেখা মেলে। পরবর্তীকালে সমাজজীবনে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে নারী হয়ে পড়ে অন্তঃপুরবাসী। আধুনিককালে নারীর অধিকার ও স্বতন্ত্র ভূমিকা স্বীকৃত হয় পাশ্চাত্যে। পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির বাহক ইংরেজদের মাধ্যমে এ দেশে নারীরাও শিক্ষার অঙ্গনে আসার সুযােগ পায় । অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা ও নারী-প্রগতির রুদ্ধ দুয়ার যায় খুলে। কিন্তু তখনও বাংলাদেশে মুসলমান নারীসমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথে বাধা দূর হয়নি। ধর্মীয় কুসংস্কার সেখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বাধা কাটিয়ে মুসলমান নারীকে শিক্ষার অঙ্গনে আনার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন বেগম রােকেয়া। ক্রমে বাঙালি মুসলিম নারীরা আধুনিক শিক্ষার পথে পা বাড়াতে থাকেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারীশিক্ষা : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় জীবনে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং গণতান্ত্রিক চেতনার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। সমাজে নারী-পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পায়। দেশে নারী-আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। বিশ্বপরিসরে নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের যােগসূত্রের প্রেক্ষাপটে জীবন ও জীবিকার নানা স্তরে নারীরা এগিয়ে আসতে থাকে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় নারীসমাজে সৃষ্টি হয় নতুন উদ্দীপনা। এখন বাংলাদেশে এমন কোনাে গ্রাম নেই যেখানে কোনাে শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারীর দেখা পাওয়া যাবে না।
নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা : নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা মাত্র ২৬ শতাংশ। ব্যাপক সংখ্যক নারী এখনও কুসংস্কার ও অজ্ঞতার অন্ধকার কাটিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা আমাদের দেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। বিশেষ করে পর্দার কড়াকড়ি এখনও একটা বড় বাধা। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও চরম দারিদ্র নারীশিক্ষার পথে বাধা হিসেবে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিপুল সংখ্যক নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে নিয়ে আসার জন্যে যে বিশাল উদ্যোগ, আয়ােজন ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামাে দরকার তা আমাদের নেই।
নারীশিক্ষা প্রসারের উপায় : প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীসমাজ যাতে শিক্ষার সুযোেগ পায় সে জন্যে প্রয়ােজন প্রচলিত ধারার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে রেডিও, টিভি ইত্যাদি মাধ্যম, লােকরঞ্জনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা-কর্মসূচি ইত্যাদি নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। নিরক্ষর নারীর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে। তাই এসব কর্মসূচিকে গ্রামীণ সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়ােজন। এসব দিক বিবেচনায় রেখে নারীশিক্ষা সম্প্রসারণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলাে নেওয়া যেতে পারে :
১. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন স্কুলগামী ছাত্রী তাদের প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে।
২. প্রতিটি নারীর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে গ্রামপর্যায়ে ছােট ছােট স্কুল স্থাপন, যেন বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি না হয়।
৩. শিক্ষাগ্রহণে নারীকে উদ্যোগী ও উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকারি উপবৃত্তি যথাযথভাবে কাজে লাগানাে।
৪. শিক্ষাখাতে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ অবকাঠামাে নির্মাণের চেয়ে নারীশিক্ষা সম্প্রসারণে বেশি করে কাজে লাগানাে এবং সে ক্ষেত্রে জবাবদিহিতাকে গুরুত্ব প্রদান।
৫. সারা দেশে নারীশিক্ষা আন্দোলন গড়ে তােলা। এই আন্দোলনে শিক্ষানুরাগী সম্প্রদায়কে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষকদের এ কাজে বিশেষভাবে নিয়ােগ প্রদান।
৬. ধর্মীয় বাধা, সামাজিক কুসংস্কার, আর্থিক দারিদ্র্য ইত্যাদি অন্তরায় কাটিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে আনার জন্যে সামাজিক প্রণােদনা সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিশেষভাবে কাজে লাগানাে।
উপসংহার : মানবাধিকার, অগ্রগতি ও প্রগতির একুশ শতকে ধর্মীয় বাধা, সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে মানুষের ভূমিকায়। আলােকিত মানুষ হিসেবে তাকে গড়ে উঠতে হবে। যুগ যুগ ধরে যে নারী চোখের জলের কোনাে মূল্য পায়নি, আধুনিক সমাজে সে নারীকে দাঁড়াতে হবে শিক্ষিত, মার্জিত, আলােকিত মানুষ হিসেবে। তাহলেই সমাজে ফিরে আসবে নারীর মর্যাদা। এ ক্ষেত্রে নারীশিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই।