বাংলা রচনা : জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা

জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা

জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা 

ভূমিকা : আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক জনগােষ্ঠীই নারী। সংসারে তারা শুধু বধূ-মাতা-কন্যার ভূমিকা পালন করে না। দেশের উন্নয়নে, দেশগড়ার কাজে, সমাজের মঙ্গলে, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অপরিসীম অবদান রেখে চলছে। নারীসমাজের এসব অবদানের কথা স্বীকার করতে গিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন一

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। 

জাতিগঠনে, দেশের উন্নয়নে যুগে যুগে নারীরা রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চাঁদ সুলতানা, লক্ষ্মীবাই, সুলতানা রাজিয়া, সরােজিনী নাইডু, মাদার তেরেসা, বেগম রােকেয়া, কবি সুফিয়া কামালের মতাে মহীয়সী নারী দেশরক্ষায়, দেশগঠনে, জাতির উন্নয়নে রেখেছেন অসামান্য ও স্মরণীয় অবদান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও নারীদের অবদান অসামান্য। 

নারীশিক্ষা ও নারীউন্নয়ন : নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে নেপােলিয়ান বােনাপার্ট বলেছেন, তােমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তােমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।'

শিক্ষা মানুষকে দেয় আত্মশক্তি, কর্মক্ষমতা, মনুষ্যত্ববােধ ও সুস্থ জীবনচেতনা। দুঃখজনকভাবে সত্য, আমাদের দেশে দীর্ঘকাল নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত। এর জন্য আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যেমন দায়ী, তেমনি নারীরাও কম দায়ী নয়। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ছিল চরমভাবে অবহেলিত, নির্যাতিত । নানা সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে নারীরা ছিল অনেকটা বন্দিনী, অবরােধবাসিনী।

এ দেশে নারীমুক্তি ও নারীপ্রগতিতে বিশেষ অবদান রাখেন রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মহীয়সী বেগম রােকেয়া। এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন শিক্ষিত নারীসমাজ ও জাতিগঠনে পুরুষের পাশাপাশি সমান শক্তি ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। 

সম্প্রতি বেজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনের স্লোগান ছিল নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন। আমাদের দেশে অফিস-আদালতে, কলকারখানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সব জায়গায় সব কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন সমানভাবে এগিয়ে আসছে। সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী তার শ্রম, মেধা, জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলছে। চিকিৎসা, প্রকৌশল, কম্পিউটার, গবেষণা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সবক্ষেত্রেই তারা যথাযােগ্য অবদান রাখছেন।

নারীর ক্ষমতায়ন : নারীর অবারিত কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত ও নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই দরকার। কারণ, দেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠী হচ্ছে নারী। এই অর্ধেক জনগােষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে দূরে রেখে কখনাে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অধিক হারে সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা যত বেশি প্রবেশাধিকার পাবে, তত তারা দেশের উন্নয়ন ও জাতিগঠনে বিশেষ অবদান রাখার সুযােগ পাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে পােশাকশিল্পে রপ্তানি আয় প্রায় পঁয়ষট্টি ভাগ। আর এ ক্ষেত্রে নারী-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রায় আশি শতাংশ। সুতরাং দেখা যায়, জাতীয় আয়ের প্রায় পঁয়ষট্টি ভাগই নারীদের হাতে অর্জিত হয়। এটি সম্ভব হয়েছে, পােশাকশিল্পে নারীশ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযােগ দেওয়ার কারণেই। 

জাতিগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা : শিক্ষিত মা শিক্ষিত জাতির জন্ম দেয়। মায়ের দোষ-গুণ নিয়ে সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়। জাতির ভবিষ্যৎ বংশধর যাতে আদর্শবান, সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে, তার জন্যে শিক্ষিতা জননীর প্রয়ােজন। বাংলাদেশে বর্তমানে উপবৃত্তি প্রচলনের ফলে নারীশিক্ষার হার যথেষ্ট বেড়েছে। এটা আমাদের সামাজিক অগ্রগতির অন্যতম লক্ষণ।

সামাজিক অপবিশ্বাস ও কুসংস্কার নারীদের আত্মবিকাশের প্রধান অন্তরায়। এসব কুসংস্কার নারীর অধিকারকে সংকুচিত করে। কুসংস্কারের কারণে তারা নিজের মতামত সাহস করে ব্যক্ত করতে পারে না। কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে নারীদের বের করে আনতে পারলে তারা জাতিগঠন ও দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। আশার কথা যে, বর্তমানে বাংলাদেশের নারীসমাজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমােচন, সমাজ উন্নয়নসহ নানাক্ষেত্রে নিজের শ্রম, মেধা প্রয়ােগ করে জাতিগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। 

উপসংহার : নারীশিক্ষার ব্যাপারে অতীতের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আজ অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। লিঙ্গবৈষম্য বা জেন্ডার ক্লাসিফিকেশন অনেক হ্রাস পেয়েছে। সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদাকর আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এসব অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে নারীর ক্ষমতায়ন যত বৃদ্ধি পাবে, জাতিগঠনে নারীসমাজের ভূমিকারও তত প্রবৃদ্ধি ঘটবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url