অভিজ্ঞতা বর্ণনা : রমনার বটমূলে বর্ষবরণ

রমনার বটমূলে বর্ষবরণ


রমনার বটমূলে বর্ষবরণ 

আজ চৈত্রসংক্রান্তি । সুতরাং কলেজে ক্লাস নেই; তবুও গেলাম । কেননা আগামীকাল ১৪২৪ বাংলা নববর্ষ । কয়েক দিন থেকেই। নববর্ষকে কীভাবে উদযাপন করা যাবে তা নিয়ে আমরা কয়েক বন্ধু ভাবছিলাম। বরাবরই আমরা এবার একটু অন্যরকমভাবেই এটি উদযাপন করতে চাই। এ নিয়ে আমরা কয়েক দফা আলােচনাও করেছি। অন্যরা আছে বিভিন্ন ধরনের পােশাক-পাতি কেনা আর আতশবাজির ধান্দায়। আমরা গুলিস্তান থেকে কমদামেই পাঞ্জাবি নিলাম, তারপর পীর ইয়ামেনী মার্কেট থেকে লুঙ্গি ও গামছা নিলাম। রাত ১২টা ১ মিনিটে আমরা পাঁচ বন্ধু পাচটি মােমবাতি জ্বালিয়ে নববর্ষকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে মােস্তফাদের বাসায় ঘুমিয়ে গেলাম। পরের দিন খুব ভােরে উঠলাম; ওদের বাসার সামনে ছােটো একটা সজনে গাছে বাবুই পাখির দেখা পেলাম; অবাক হলাম। ভেবে যে ঢাকা শহরে বাবুই পাখিও থাকে। সকালের চমৎকার বাতাস বয়ে যায়। অথচ এ সময় ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ থাকে ঘুমিয়ে। অবশ্য এর মধ্যে আমিও আছি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মােস্তফাসহ সবাই জেগে উঠল। মােস্তফা বের হয়েই বললাে, ‘শালা ওমন তাকিয়ে কী দেখিস? শুধু বললাম আজ নববর্ষ । ও তাই তাে― ‘শুভ নববর্ষ ‘শুভ নববর্ষ'। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখি খালা আম্মা আমাদের জন্য নাশতা তৈরি করে ফেলেছেন। চমৎকার খিচুড়ি আর তার সাথে ডিমভাজা। একেবারেই পেটপুরে। খেলাম। এরপর যথারীতি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আর মাথায় গামছা বেঁধে যেই বের হতে ধরেছি একেবারে যমদূতের মতাে খালু সামনে হাজির। ভাবলাম আমাদের এই পােশাক দেখে খালু কী যেন বলে কিন্তু দেখলাম এত গম্ভীর মানুষ অথচ তিনি বলেছেন‘চমৎকার! তবে শুধু একদিন বাঙালি হইও না। আমরা কিছুটা সংকোচের সঙ্গে তাঁর কাছ থেকে চলে যেতে পারলেই বাচি এমন করেই যেন সরে পড়লাম। ঢাকা শহরে আজ তেমন যানবাহন নেই; অগণিত মানুষ ফার্মগেট থেকে পায়ে হেঁটে শাহবাগের রমনার বটমূলে। যাচ্ছে। আমরাও ঐ পােশাকে হেঁটে চললাম। পথে দেখলাম মেয়েরা আজ রং-বেরঙের শাড়ি-চুড়ি পরেছে। সত্যি তাদের বাঙালি ললনার মতাে মনে হচ্ছে। রমনার বটমূল ঘিরে মানুষ আর মানুষ; রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান বর্ষবরণের গান। আমাদের প্রিয়শিল্পী রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে ভেসে আসল ‘এসাে হে বৈশাখ...।' এরপর আবৃত্তি; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা―‘আমাদের ছােট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। পাশের লেকটিকে মনে হলাে যেন ছােটো নদী। মুহূর্তেই { স্মৃতিতে চলে গেলাম গ্রামের সেই ছােটো তিস্তার শাখা নদীতে; যেখানে হাঁটুজলে কত না মাছ ধরেছিলাম। কিন্তু এত আয়ােজনের { মধ্যেই একজনকে খুব বেমানান মনে হলাে। জীর্ণ-বস্ত্রে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন, মুখটি তার বড়াে শুকনাে । সবাই হৈচৈ করছে অথচ ; তিনি একদম নীরব । ভাবছিলাম তিনি হয়তাে কিছুক্ষণ পর সবার কাছে সাহায্য চাইবেন। না তা নয়; বরং তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে : দাঁড়ালেন। সবাই আজ খুশি অথচ তার দিকে ফিরে তাকানাের জন্য কারাে অবকাশ নেই। আমরা কাছে গিয়ে বললাম― ‘চাচা আপনার বাড়ি কোথায়? কোনাে অসুবিধা? তিনি কষ্ট করে যেন চোখটি খুলে তাকালেন, বললেন ‘বাবা মনডা ভালা না । পােলাডার অসুখ। তারপর জানতে পারলাম জাতীয় হৃদরােগ ইনস্টিটিউটে তার ছেলের ভাঙ পরিবর্তন করতে হবে। এতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার দরকার। কিন্তু বৃদ্ধ গ্রামের একটি ছােটো মুদি দোকানদার। মুহূর্তেই মনে হলাে― আজ রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে আর প্রত্যেকে যদি মাত্র ১ টাকা করে দেয় তাহলেই তাে প্রায় দেড় লাখ টাকা হয়ে যাবে । বৃদ্ধ তার সন্তানকে বাঁচাতে পারবে; তাই নববর্ষের আনন্দ সেও ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। তবেই তাে দিনটির সার্থকতা। চল আমরা এরকম একটা মহৎ কাজের মধ্য দিয়ে নতুন বছর ১৪২৪-কে গ্রহণ করি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url