বাংলা রচনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
অথবা, আমাদের পােশাক শিল্প : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
অথবা, আমাদের পােশাক শিল্প
অথবা, পােশাক শিল্প : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
অথবা, পােশাক শিল্প ও বাংলাদেশ
[ সংকেত: ভূমকা; পােশাক শিল্পের অতীত ও বর্তমান অবস্থা; পােশাকের বাজার; অর্থনীতিতে অবদান; পােশাক শিল্পের সমস্যা; সমস্যা সমাধানের উপায়; উপসংহার। ]
ভূমিকা :
বাংলার মসলিন বােগদাদ রােম চীন
কাঞ্চন মূল্যেই কিনতেন একদিন।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এ পঙক্তিদ্বয় প্রাচীন বাংলার পােশাক শিল্পের ব্যাপক চাহিদার কথাই ঘােষণা করে। কিন্তু বেনিয়া ব্রিটিশদের চক্রান্তে সাময়িকভাবে তা থেমে গিয়েছিল। আবার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ শিল্পই বৃহদায়তন শিল্প হিসেবে স্বদেশের চাহিদা মিটিয়ে আজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এর রপ্তানির পরিমাণ। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ খাতের অবদান বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। পােশাক শিল্পের অতীত ও বর্তমান অবস্থা : তৈরি পােশাক বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হিসেবে স্বীকৃত। তবে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে পােশাক শিল্প খাত সম্পর্কে ব্যবসায়ী মহলে তেমন কোনাে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল না । এদেশে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে পােশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতাে তৈরি পােশাক রপ্তানি শুরু হয়। ৮০'র দশকে এ খাত বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে। বর্তমানে এ খাত দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী সর্ববৃহৎ খাত হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এ খাত গড়ে প্রতি বছর ২১.৫৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। দ্রুত বিকাশমান এ খাত থেকে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭৫% অর্জিত হচ্ছে ।
পােশাকের বাজার : বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ২০টিরও অধিক দেশে পােশাক রপ্তানি করছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পােশাকের অন্যতম ক্রেতা। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে পােশাক রপ্তানি করে মােট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৬% অর্জিত হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার : হচ্ছে ইউরােপীয় ইউনিয়ন তথা জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইসিভুক্ত দেশগুলাে। পােশাক শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৮৪টি ক্যাটাগরি আছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ ৩৬টি ক্যাটাগরি উৎপাদন করে থাকে, যার মধ্যে ১৮টি ক্যাটাগরি কোটাভুক্ত এবং বাকি ১৮টি ক্যাটাগরি কোটা বহির্ভূত।
অর্থনীতিতে অবদান : দেশের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি বিশেষ করে মহিলা শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে পােশাক শিল্প দেশের সার্বিক শিল্পায়নে গতি সৃষ্টি করেছে। এ শিল্পের দ্রুত ক্রমবর্ধমানতার কারণে দেশে একদল উদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। যারা আর্থনীতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। এ শিল্পে বর্তমানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। ফলে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশের আর্থনীতিক যােগান দিচ্ছে পােশাক শিল্প, যার ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়ােজনীয় বিবিধ দ্রব্যসামগ্রী, যেমনপ্রসাধনী, জুতা, খাদ্য ইত্যাদির বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। এ শিল্পের একটি অতি প্রয়ােজনীয় উপাদান হচ্ছে তরল অর্থ। তাই ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ক্রমশ খুলে যাচ্ছে বিস্তৃত দ্বার । এ শিল্পের বিকাশের কারণে সড়ক ও বিমানপথের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল দিগন্তের । বর্তমানে অনেক স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান পােশাক শিল্পের সহায়ক শিল্প যেমন- কার্টন, পলি প্যাকেট, সুতা, বােতাম, পলিব্যাগ, লেবেল, নেকবোের্ড ইত্যাদি উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে উন্নতির ছোঁয়া লাগছে, যা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পােশাক শিল্পের সমস্যা : বর্তমানে ১০০% রপ্তানিমুখী তৈরি পােশাক শিল্প পড়েছে গভীর সংকটে। গার্মেন্টস শিল্পে এ অনিশ্চয়তা প্রথমত শুরু হয় ১০০৫ সাল থেকে এমএফএন কার্যকরী ও জিএসপি বন্ধের কারণে। এর ফলে গােটা শিল্পে নেমে আসে স্থবিরতা । ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়েন উদ্বিগ্ন। তাছাড়া ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার প্রেক্ষিতে অর্থনীতির দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, বাজার সংকুচিত হওয়া, পণ্যমূল্য কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে গার্মেন্টস শিল্প কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল।বাজারে পােশাকের মূল্য নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। বাজারে প্রবল প্রতিযােগিতায় বিভিন্ন ওভেন পােশাকের মূল্য কমে। যায়। সচল কারখানাগুলাে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ তখন কাজে লাগাতে পারছিল । গার্মেন্টস শিল্পে অপচয়ও একটি বড়াে সমস্যা ছিল।অদক্ষতা এবং অপচয় রােধ করার মতাে কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এসব শিল্প কম মূল্যের আন্তর্জাতিক বধা করতে পারেনি। অথচ উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে অপচয় কমিয়ে আনতে পারলে পণ্যমূল্য কমিয়েও বাজার ধরে রাখা সম্ভব। ২০১৩ সালে পােশাক শিল্পখাতে ভয়াবহ কয়েকটি দুর্ঘটনার জের ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পােশাক আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এই সুবিধা পেতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সমস্যা সমাধানের উপায় : বর্তমানে পােশাক শিল্পের সমস্ত সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। সরকারি নগদ, সহায়তার ১০০ ভাগ অবমুক্তকরণ এবং তা সময়মত উদ্যোক্তাদের হাতে পৌছাতে হবে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে তুলা, সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ নিতে হবে। বাণিজ্যনীতি ও শিপিং খাত সংস্কার করতে হবে। সার্ক কিউমুলেশন বাস্তবায়ন ও দেশে সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যার হাউস চালু করতে হবে। পণ্যের মান বাড়ানাের পাশাপাশি অপচয় কমিয়ে পণ্যমূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও বাণিজ্য নেগােসিয়েশনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিনিধি বাড়ানাের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ সহায়তা সংক্রান্ত রীতিনীতি শিল্প। উদ্যোক্তাদের অনুকুলে নিয়ে আসতে হবে। লিড-টাইম কমিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের সুযােগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রুগণ শিল্প পুনরুজ্জীবনে সহায়তা এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অর্জনকারী এ শিল্পের এখন প্রয়ােজন। সার্বিক সংস্কার। সরকার, উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে যদি সময় মতাে সিদ্ধান্ত না নেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এটিও পাট শিল্পের মতাে ইতিহাস হয়ে যেতে পারে।
উপসংহার : গুণগত মান দিয়ে বিশ্ব বাজারে স্থান করে নেওয়া পােশাক শিল্প বর্তমানে রপ্তানি চালিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭৮-৭৯ সালে যেখানে এ শিল্পের অবদান ছিল ১৬ লক্ষ টাকা, সেখানে ১৯৯৮-৯৯ সালে এ শিল্পের অবদান দাঁড়ায় প্রায় ১৪,৩৪৬.৯১ কোটি টাকায়। বর্তমানে এর অবদান প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয়ে এ বিশাল অবদানের জন্য এ শিল্পকে। বিলিয়ন ডলার শিল্প হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতের মােট রপ্তানি আয়কে ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সুতরাং পােশাক শিল্পে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা ও সকল মহলের সহায়তা একান্ত প্রয়ােজন।