যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন
যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন
ভাষা মানুষের সবচেয়ে সংবেদনশীল সৃষ্টি। সৃষ্টির সেরা হওয়ার পেছনে মানুষের যে সৃষ্টি সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবি করতে পারে সেটি হলাে ভাষা। এটি একটি শৈল্পিক কর্ম । শিল্পকর্মের মতােই ভাষাকে নানান উপাদানে সজ্জিত করা আবশ্যক। নইলে স্বকীয়তা, সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা রক্ষিত হয় না। অথচ এগুলােই হলাে ভাষার প্রাণ। কথা বলার সময় কেউ ইচ্ছেমতাে বলে না। দম নেওয়ার জন্য কিংবা বাক্যের অর্থকে স্পষ্ট করার জন্য কোথাও থামতে হয়। আবার কোথাও গলার স্বর নানা ভঙ্গিমায় পরিবর্তন করতে হয়। তবে এ থামাও যেমন ইচ্ছা তেমন নয়। এসবের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এ নিয়ম অনুযায়া কোথাও কখনাে বেশিক্ষণ আবার কোথাও বা অল্পক্ষণ থামতে হয়। বাক্যের অর্থ স্পষ্টভাবে প্রকাশের জন্য বাক্যের মধ্যে বা বাক্যের শেষে থামার কিংবা আবেগ, হর্ষ, বিষাদ, জিজ্ঞাসা ইত্যাদি অনুভূতি প্রকাশের নির্দেশনা দিতে নিয়মিত বর্ণের অতিরিক্ত যেসব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় সেগুলাে যতি বা ছেদচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন নামে পরিচিত।
গলার স্বরের উঠানামায় বা বলার ঢঙে বক্তার মেজাজ ধরা পড়ে। বিস্ময় প্রকাশ বা প্রশ্ন করা, অনুরােধ করা বা ধমক দেওয়া ইত্যাদিসহ সবই বাক্যের মাধ্যমে কথা বলার ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তােলা যায়। তবে এজন্য কিছু নির্দেশনা পালন করতে হয়। কথা না বলে যদি লেখার মাধ্যমে বক্তব্য, মনােভঙ্গি ইত্যাদি জানতে হয়, তখন কথা বলার সময় যে-যে ভাব ও ভঙ্গি দেখানাে সমীচীন, লেখার ভেতরেও সেই মনােভাব ও ভঙ্গিটা ফুটিয়ে তােলা প্রয়ােজন হয়। যেসব চিহ্ন দিয়ে এগুলাে চিহ্নিত করা হয় সেগুলাে যতি বা বিরামচিহ্ন নামে পরিচিত।
বাক্যের বিভিন্ন ভাবভঙ্গি সুন্দর, সার্থক ও নান্দনিকভাবে প্রকাশের লক্ষ্যে স্থানবিশেষে থামা এবং কণ্ঠস্বরের ভাবভঙ্গির তারতম্য নির্দেশনার জন্য বর্ণের অতিরিক্ত যেসব চিহ্ন ব্যবহৃত হয় তাদের বিরামচিহ্ন বলে। এদের ভাষা-চিহ্নও বলা হয়। বিরামচিহ্ন’-এর অর্থ- যে চিহ্নের সাহায্যে কথা বলার সময় জিভের কাজের বিরাম ঘটে বা বিরাম নির্দেশিত হয়। মনােভাব প্রকাশের সময় অর্থ ভালােভাবে বােঝানাের জন্য উচ্চারিত বাক্যের বিভিন্ন স্থানে বিরাম দিতে হয় এবং গলার স্বর পরিবর্তন করতে হয় । লিখিত বাক্যের মধ্যে বিরাম নির্দেশের জন্য এসব সাংকেতিক চিহ্ন বা ভাষা চিহ্ন অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। এগুলাে ছাড়া বাক্য তার অর্থ, গতি ও গ্রহণযােগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
বিরামচিহ্নের সংজ্ঞার্থ
বাক্যের বিভিন্ন ভাব সার্থকভাবে প্রকাশের জন্য থামার কালজ্ঞাপক নির্দেশনাসহ কণ্ঠস্বরের ভঙ্গির তারতম্য বােঝানাের লক্ষ্যে বাক্যে অতিরিক্ত যেসব চিহ্ন ব্যবহৃত হয় তাদের বিরামচিহ্ন (Punctuation) বলা হয়।
বিরামচিহ্নের ইতিহাস
বিরামচিহ্ন ভাষার সৌন্দর্য, ওজস্বিতা ও অর্থদ্যোতনার অন্যতম নিয়ামক। বিরামচিহ্ন পাঠকের সামনে লেখকের পূর্ণ মনােভাব তুলে ধরার কাজ বিশ্বস্ততার সঙ্গে করতে পারে। বিরামচিহ্নের ব্যবহারকে ইংরেজিতে বলে Punctuation। এর মূল গ্রিক শব্দ Punctus যার অর্থ বিন্দু।
এই বিন্দু ব্যবহৃত হতাে হিব্রু ভাষার লিপিতে ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির সংকেত হিসাবে। পরবর্তীকালে তা vowel আর point প্রায় সমার্থক হয়ে point কথাটির সৃষ্টি হয়। এই point পঞ্চদশ শতকে period of full stop ব্যবহৃত হয়। কমা, কোলন, হাইফেন শব্দগুলাে ছেদ বা অঙ্গচ্ছেদবাচক। ড্যাশ’ কথাটিতে আছে হঠাৎ সরে যাওয়ার ইঙ্গিত । অন্যান্য চিহ্ন এসেছে অনেক পরে। কিছু চিহ্ন স্বরলিপি চিহ্নের পরিবর্তিত রূপ, যাদের তাৎপর্যও কালক্রমে বদলে গেছে। গ্রিক-লাতিন পাণ্ডুলিপিতে সেমিকোলন (;) ছিল প্রশ্নাত্মক। আজ তা অন্য অর্থ বহন করে।
আমাদের দেশে বৈদিক সাহিত্যে একসময় বহুল-ব্যবহৃত ব্ৰজাদি চিহ্ন () এখন আর নেই। ধ্বনিগত পরিবর্তনের ফলে এদের বিলুপ্তি ঘটেছে। বাংলা পাণ্ডুলিপিতে এক দাঁড়ি (।) এবং জোড় দাঁড়ি (।।) ছাড়াও 0।, ০০,০।। ০ ইত্যাদি চিহ্ন বিরামের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে পক্তিপূরক হিসেবে '-' ড্যাশের ব্যবহার ছিল। এই ‘' চিহ্নহ্রস্ব দীর্ঘ-তাে পঙক্তি পূরণের প্রয়ােজনে। ত্রিবিন্দুর (∴) প্রচলনও ছিল প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কেবল এক দাঁড়ি (।) এবং জোড় দাঁড়ি (।।) — এই দুই বিরামচিহ্নের ব্যবহার হতাে। যেমনপ্রথম চরণের শেষে এক দাড়ি এবং দ্বিতীয় চরণের শেষে জোড় দাঁড়ি ব্যবহারের নিয়ম ছিল। বাংলা প্রাচীন পুথিতে শব্দগুলাে থাকত এক সঙ্গে।
যেমন- সীতাহারাআমিযেনমনিহারাফণী ।