ভাব-সম্প্রসারণ : মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন

মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন

মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন।

অথবা, 

সুসময়ে অনেকে বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারাে নয়।

ভাব-সম্প্রসারণ : মিত্রত্ব মানুষের মনুষ্যত্বের উৎকৃষ্ট পরিচায়ক। পৃথিবীতে বাস করতে হলে মিত্রত্ব অপরিহার্য । সমাজে একই সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানাভাবে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই বন্ধুত্ব যত সহজে গড়ে ওঠে তা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা তত সহজ হয় না । লােভ, হিংসা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতার পথে ঠেলে দেয় বলে তখন বন্ধুত্ব বা মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়ে। 

দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, যারা সমাজে বাস করে না, তারা হয় দেবতা নয় তাে পশু। ভালাে-মন্দ, দোষ-গুণ নিয়ে মানুষ সমাজে বাস করে। তাই সে সমাজবদ্ধ সামাজিক জীব। সমাজের আবেষ্টনীতে প্রত্যেক মানুষ প্রত্যেকের ওপর কোনাে না কোনােভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার জন্যই পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে; মানুষ বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়ে। মূলত সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে সুন্দরভাবে বাস করতে হলে প্রত্যেকেরই ইচ্ছায় হােক বা অনিচ্ছায় হােক একে অন্যের সাথে একটা সম্পর্ক হয়েই যায়। এভাবে অনেক বন্ধুই জীবনে পাওয়া যায়, যদিও প্রকৃত বন্ধু হিসেবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে হাতে গােনা কয়েকজন মাত্র। কেননা বাস্তবে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। মানুষের জীবনে অধিকাংশ বন্ধুত্ব হয়। একতরফা ও উদ্দেশ্যনির্ভর । সহজাতভাবেই একতরফা সম্পর্ক বেশি দিন টিকে থাকে না। অন্যদিকে, যাদের চরিত্রে দীনতা, সংকীর্ণতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি থাকে তারা নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপরের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তােলে। কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির পর সেই ক্ষণস্থায়ী বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। সুবিধাবাদী এসব লােক নিজের স্বার্থ পূরণের পর উপকারীর সঙ্গে আর সম্পর্ক রক্ষা করে না। বস্তুত আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে মৈত্রীর বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ক্ষুদ্র স্বার্থ-চিন্তা ও মানবীয় কুপ্রবৃত্তি পারস্পরিক সম্প্রীতির ভিতে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। যার ফলে, দীর্ঘদিনের সম্পর্কও ভঙ্গুর কাচের মতাে মুহূর্তের মধ্যে। ভেঙে খান খান হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, যে বন্ধুত্ব নিঃস্বার্থ, আত্মিক ও পারস্পরিক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ, সে বন্ধুত্বই প্রকৃত বন্ধত। আমাদের সংসারে দুঃখ আছে, বিপদ আছে, আছে পরাজয়, লাঞ্ছনা, অপমান। কিন্তু এসব বিরুদ্ধশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে, তারাই প্রকৃত বন্ধু এবং এসব মহৎপ্রাণ শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গেই মিত্রত্ব রক্ষা করা সহজ হয়ে ওঠে। 

মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট রাখতে চিত্তের উদারতা, নিঃস্বার্থপরায়ণতা, সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতা একান্তভাবে আবশ্যক। অতএব আন্তরিকভাবে প্রত্যেকের প্রয়ােজনকে সমানভাবে মূল্যায়ন করে, মনুষ্যত্বের যথাযথ প্রয়ােগ ঘটিয়ে মিত্রতা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url