বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ
অথবা, বিশ্বায়ন
[ সংকেত: ভূমিকা; বিশ্বায়ন; বিশ্বায়ন ও অর্থনীতি; বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক; বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক; বাংলাদেশে বিশ্বায়নের প্রভাব; বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের করণীয়; উপসংহার। ]
ভূমিকা : ইংরেজি ‘Global’ শব্দ থেকে Globalization শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার বাংলা প্রতিশব্দ হলাে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলাে সমগ্র মানবজাতিকে কোনাে নির্দিষ্ট ভখণ্ডে আটকে না রেখে বিশ্বব্যাপী তার পদচারণাকে অবারিত করে তােলা। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব তথ্য বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। মানুষের জীবনযাত্রায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমসম্প্রসারণ এক প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। উন্নত যােগাযােগের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযােগ পাচ্ছে। মানুষ তার জীবনযাপনের পরিবেশ থেকে ভৌগােলিক সীমাবদ্ধতা দূর করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুদূরপ্রসারী ও সম্প্রসারণশীল বিষয় আবিষ্কার, ধারণা, সুবিধা ইত্যাদির সাথে নিজেকে যুক্ত করতে উৎসাহী হয়ে উঠছে। মানুষের অবস্থানের । ভৌগােলিক সীমা আর মানসিকতার বন্ধ্যাত্ব থেকে উত্তরণের এই প্রচেষ্টা এবং বিশ্বব্যবস্থার বহুমাত্রিকতার সাথে নিজেকে যুক্ত করার ৫ জন্য আধুনিককালে যেসব ব্যবস্থা ক্রমাগত তাত্ত্বিক রূপ লাভ করেছে তাই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া।
বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন বলতে সমগ্র বিশ্বকে আধুনিকতা ও অগ্রগতির এক বলয়ে সমন্বিত করার একটি তত্ত্ব বা ধারণাকে বােঝায়। এই ধারণার সূত্রপাত ঘটেছে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে। এ কারণেই বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বজুড়ে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে বােঝানাে হয়ে থাকে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন হলাে সমগ্র বিশ্বকে একটিমাত্র বিশাল রাজ্যে একত্রীকরণ করা। এ বিশ্বায়নের যেমন সুফল রয়েছে, তেমনি কুফলও রয়েছে। বিশ্বায়নের কারণে ধনী রাষ্ট্রগুলাে আরও ধনী এবং গরিব রাষ্ট্রগুলাে আরও ? গরিব রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। ড. আলি আসগর বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-“উন্নত দেশ থেকে আমদানিকৃত সামগ্রী, ধার * করা জ্ঞান ও তথ্য বিশ্বায়নকে বােঝায় না এবং সৃজনশীল উদ্ভাবন ও আবিষ্কার জ্ঞানের জগৎকে যে দ্রুত বদলে দিচ্ছে এবং সৃষ্টি , করছে এক দ্রুত পরিবর্তনশীল অবিচ্ছিন্ন জগতের, তার সমগ্রতাই এর বহুমাত্রিকতা এনেছে। তাই বলা যায়, বিশ্বায়ন হলাে বিজ্ঞান। ও প্রযুক্তির বিভিন্ন অবদানকে দীর্ঘদিন যাবৎ শােষণ করে জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় ঘটানাে।
বিশায়ন ও অর্থনীতি : মানবজীবন পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। বলা যায়, অর্থই মানবজীবশেম " সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতি সকল কিছুই আর্থনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। বিশ্বায়ন মানবগােষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃপারিবারিক যােগাযােগ মাধ্যম হলেও এটি একটি আর্থনীতিক প্রত্যয় অর্থনীতিই বিশ্বায়নের পেষণা । ড সিরাজল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বিশ্বায়ন কোনাে নতুন বিষয় নয়, এটি পুরাতন বাস্তবতার নতুন নাম এবং সেই বাস্তবতা হলাে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদই নতুনরূপে বিশ্বায়নের নাম ধরে এসেছে।
বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক : বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দূরত্ব কমে এসেছে। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতির দিক দিয়ে তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী বৃহৎ বাজার সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে কমছে উৎপাদন ব্যয় । বিশ্বায়নের ফলে অবাধ বাণিজ্যের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ঘরে বসেই দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে। যে দেশ যত বেশি উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করবে সে দেশ ততবেশি। লাভবান হবে। আবার পৃথিবী ভ্রমণ করার জন্য এখন আর জগৎ দেখার প্রয়ােজন নেই। বর্তমানে ইন্টারনেট সুবিধার মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্বপরিভ্রমণ করা যায়। পৃথিবী আজ একটি ছােটো গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের দেশগুলাের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সংঘাত হ্রাস করে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতার কারণে। বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠছে পারস্পরিক সহযােগিতামূলক আর্থনীতিক জোট। যেমন- ‘জি-৮', ৭৭ জাতি গ্রুপ’, ‘এপেক’ ইত্যাদি। মূলত World Bank, WTO, IMF, EEC, NAFTA, SAPTA, ASEAN ইত্যাদি সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে উঠছে বিশ্বপল্লির অধিবাসী। বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক : বিশ্বায়নের যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে নেতিবাচক দিক। মুক্তবাজার অর্থনীতির, আওতায় বিশ্বায়ন উন্নত দেশের জন্য বিশ্বসম্পদের দ্বার খুলে দিলেও দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশের জন্য বয়ে এনেছে অভিশাপ। বিশ্বায়নের ফলে দরিদ্র দেশের মেধা অবাধে ধনী দেশগুলােতে পাচার হচ্ছে। এতে ধনী দেশগুলাে আরও ধনী হচ্ছে আর গরিব দেশগুলাে হচ্ছে আরও গরিব । বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে অসম প্রতিযােগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দরিদ্র দেশের বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযােগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হচ্ছে। বিশ্বায়নের একটি অন্যতম নেতিবাচক দিক হলাে রাষ্ট্রীয় গােপনীয়তা রক্ষিত না হওয়া। বিশ্বায়নের ফলে ঘটছে বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। বিশ্বায়নের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলাে ক্রমশই এদের পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশ দূষণকারী রাষ্ট্র হলাে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপীয়ান ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি উন্নত দেশ। তারা পরিবেশ রক্ষার কথা বলে উন্নয়নশীল দেশগুলাের ওপর বিভিন্ন শর্ত আরােপ করে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন উন্নত দেশগুলাের জন্য আশীর্বাদ হলেও অনুন্নত দেশগুলাের ধ্বংসের প্রধান কারণ।
বাংলাদেশে বিশ্বায়নের প্রভাব : ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে কথিত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। তখন বিশ্বের সম্পদ ও প্রযুক্তির যে বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল তার ছোঁয়া বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে বিনিয়ােগের প্রলােভন দেখালেও সেখানে ছিল অনেক অনিয়ম। বাজার উন্মুক্ত করার কারণে আমাদের দেশীয় শিল্পগুলােকে কঠিন প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এই প্রতিযােগিতার ফলে অনেক শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুল্ক হ্রাস প্রক্রিয়ায় শুল্কের হার যদি শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তবে বাংলাদেশকে তার শিল্প অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে হবে। ২০০০ সালে FDI (Foreign Direct Investment) ছিল ২৮ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০১ সালে ছিল মাত্র ৭ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার। এরূপ বৈদেশিক মদার, হাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশে একদিকে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের অভাব, অন্যদিকে অর্থনীতিতে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব । বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর MFA (Multi Fifer Agreement) চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ চুক্তি শেষ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, ফলে বাংলাদেশকে পড়তে হয়েছে মুক্তবাজারের প্রতিযােগিতায়। এ প্রতিযােগিতায় টিকে থাকার জন্য দ্রব্যের যে গুণগতমান থাকা প্রয়ােজন তা বাংলাদেশ সবক্ষেত্রে দিতে পারছে না, ফলে বিশ্ববাজারের এই প্রতিযােগিতায় টিকে থাকা খুবই কষ্টসাধ্য। আবার উন্নত দেশের উন্নত দ্রব্যসামগ্রী বাংলাদেশের বাজারকে দখল করে নিয়েছে। এ কারণে দেশীয় পণ্যের বাজার হারিয়েছে তার অবস্থান। বিশ্বায়নের ফলে যে অবাধ বাণিজ্যের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে তা ক্রমশই । বাংলাদেশকে বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত করছে। বিশ্বায়নের কারণে বাংলাদেশের কৃষি হুমকির মুখে পড়েছে। দেশীয় প্রক্রিয়ায়। উৎপাদিত বীজ বিলুপ্তির কারণে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বীজ। শুধু বীজই নয় এর সাথে রয়েছে। কেমিক্যাল, সার ও বিভিন্ন কীটনাশক ঔষধ । বিশ্বায়নের অবদান আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিও হারাতে বসেছে নিজের অবস্থান। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে বিভেদ তাও বিশ্বায়নের প্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়ন সকল দেশকে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখালেও উন্নয়নশীল দেশগুলাে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিষাক্ত ছােবলে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।
বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের করণীয় : বিশ্বায়নের স্রোতে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশসহ উন্নয়শীল দেশগুলাের উচিত রাষ্ট্রের ভৌত কাঠামাের উন্নয়ন করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ সামাজিক ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রসমূহে বিনিয়ােগ বৃদ্ধি করা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করে তাতে তথ্যপ্রযুক্তিসহ গবেষণাধর্মী বিষয়গুলাে আরও ব্যাপকভাবে গবেষণা করা। চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক আত্মনিয়ােগ। অস্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবেশকে চিরতরে নির্মূল করে সংযত ও সহনশীল তথা স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
উপসংহার : তথ্যপ্রযুক্তির অকল্পনীয় বিকাশের ফল হিসেবে বিশ্ব আজ যে যােগাযােগ স্তরে পৌঁছেছে বর্তমানে নিজের অস্তিত্ব বজায় | রাখতে হলে কোনাে দেশের পক্ষেই এ যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। আত্মরক্ষা এবং আত্মবিকাশ উভয় কারণেই বিশ্বকে আজ বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। পাশাপাশি যেভাবে বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিকগুলাের সুফল ভােগ করা যায় এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা যায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এজন্য নিশ্চিত করতে হবে রাজনীতিক স্থিতিশীলতা এবং যাবতীয় দ্রব্যের সুষম বণ্টন। বিশ্বায়নকে আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত করে আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে । আর তা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসা এবং সৃজনশীল প্রেরণায় কঠোর পরিশ্রম করা।