বাংলা রচনা : নিয়মানুবর্তিতা
নিয়মানুবর্তিতা
[ সংকেত: ভমিকা; নিয়মানুবর্তিতা কাকে বলে, প্রকতির রাজ্যে নিয়মানুবর্তিতা; নিয়মানুবর্তিতার প্রয়ােজনীয়তা; পমপে ৩ গান জাবনে নিয়মানুবর্তিতা; ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা; ব্যক্তিজীবনে নিয়মানুবর্তিতা; নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তিস্বাধানতার অন্তরায় নয়; নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব; উপসংহার। ]
ভূমিকা :
বিশ্বজগতের সবকিছুর মধ্যেই নিয়ম রয়েছে। পার্থিব কোনাে ঘটনাই নিয়ম বহির্ভূত নয়। এ জগৎ শৃঙ্খলার জালে বাধা। নিয়মের জালে আটকানাে । অণু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত, এই মহাবিশ্বে যা কিছু দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য সবকিছুই একটি বিশেষ সজ্জায় সাজানাে, একটি বিশেষ শৃঙ্খলে বাধা। এই শৃঙ্খলাই হলাে নিয়ম। এই যে কথা বলছি, লেখা পড়ছি- এখানেও রয়েছে নিয়মের শৃঙ্খলা, ধ্বনির শৃঙ্খলা। প্রকৃতপক্ষে, পার্থিব জীবনে যখন যা করার নিয়ম বা বিধি রয়েছে তা যথাসময়ে পালন করার নামই নিয়মানুবর্তিতা। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই পৃথিবীর সব কাজে নিয়ম অনিবার্য। এজন্য Nepoleon বলেছেন, Disciplie is the keystone to success which is compulsory to follow to balance the systems.
নিয়মানুবর্তিতা কাকে বলে : নিয়মানুবর্তিতা বলতে বােঝায়, যেভাবে যা হওয়া উচিত তা হওয়া এবং যখন যা করা উচিত তা যথাযথভাবে করা। অর্থাৎ কল্যাণের পথে থেকে ব্যক্তিপর্যায় হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত জীবন পরিচালনার সাধনাকে নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবােধ বলে। মানুষ সামাজিক জীব বিধায় সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হলে অবশ্যই কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। নিয়মের কারণেই মানুষ সমাজ সৃষ্টি করে একত্রে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়েছে। এ অতএব, নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করাকেই নিয়মানুবর্তিতা বলা হয়। বস্তুত ব্যক্তির কল্যাণে, জাতির কল্যাণে এবং দেশের কল্যাণে নিয়মানুবর্তিতা একান্ত প্রয়ােজন। কেননা নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলাবােধের জন্ম দেয় এবং মানুষকে কর্তব্য পালনে সচেতন করে তােলে।
প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মানুবর্তিতা : স্রষ্টাই প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক। তিনিই প্রকৃতিকে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালনা করছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে স্রষ্টা প্রদত্ত এ নিয়মের কোনাে ব্যত্যয় নেই। সৃষ্টির আদি থেকে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে। নির্দিষ্ট নিয়মে দিবা-রাত্রির সংঘটন হচ্ছে। বস্তুজগতের প্রতিটি বস্তুই স্বকীয় ধর্ম এবং বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রতিটি প্রাণীর কর্মকাণ্ড একটি ৩ নিয়মের অধীনে নিয়ন্ত্রিত। জন্ম থেকেই আমরা এসব অমোঘ নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। আর প্রকৃতিতে এসব চিরাচরিত নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় হলেই বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ বিপর্যয় যে কত ভয়ংকর তা গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, ওজোনস্তরের ক্ষয়, পরিবেশ ধ্বংস, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ভূমিধস ইত্যাদি দেখে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। তাই প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষকে তার নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
নিয়মানুবর্তিতার প্রয়ােজনীয়তা : জীবনের সর্বস্তরেই নিয়মানুবর্তিতার প্রয়ােজন রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ পিরবারের সদস্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা না থাকলে পরিবারে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এজন্য শৃঙ্খলাবােধ আত্মস্থ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিটি মানুষেরই দায়িত্ব বড়ােদেরকে শ্রদ্ধা ও ছােটোদের স্নেহ করা এবং সমাজের অন্য সব দায়-দায়িত্ব সুশৃঙ্খলভাবে পালন করা তাদের কর্তব্য। নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কোনাে বিকল্প নেই। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, খেলার মাঠ, কলকারখানা ইত্যাদিতে নিয়মানুবর্তিতার অভাবে চরম নৈরাজ্য দেখা দেয়। বিশেষ করে খেলার মাঠে ও যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রয়ােজন গভীরভাবে অনুভূত হয়ে থাকে। বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের একমাত্র কারণ উচ্ছঙ্খলতা। বস্তুত নিয়ম ছাড়া কোনাে কাজই সুষ্ঠুভাবে ও যথাসময়ে সঠিক মান অক্ষুন্ন রেখে সম্পন্ন করা যায় না। তাই জীবনে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম। শৃঙ্খলার সিঁড়ি বেয়েই মানুষ আজকের দিনের এই সমাজ ও সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশ ও জাতির ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে তাদের জাতিগত সার্বিক শৃঙ্খলাবােধ। অতএব, নিয়মানুবর্তিতাই উন্নতির চাবিকাঠি- একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য ।
সমাজ ও জাতীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা : সমাজে ও জাতীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করা অপরিহার্য। নিয়মানুবর্তিতা ব্যতীত কোনাে জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির কথা ভেবেই মানুষকে সামাজিক শৃঙ্খলা অনুসরণ করতে হয়। অস্তিত্বের প্রয়ােজনেই মানুষ সামগ্রিক সমাজচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। জীবন-বিকাশের জন্য তাকে নানান উপকরণ-বৈচিত্র্যে, সুন্দরতম করার জন্য নিয়মানুবর্তিতা অপরিহার্য। সামাজিক জীবনের মতাে মানুষকে রাষ্ট্রীয় জীবনেও কতকগুলাে আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। সেসব আইন মেনে চলার মাঝেই জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। শৃঙ্খলাবােধই জীবনগঠনের বােধমন্ত্র। এই মন্ত্রোচ্চারণেই মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারে মেতে ওঠে।
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা : Work while you work, play while you play and that is the way to be happy and gay. এ নিয়ম ছাত্রছাত্রীদের সর্বদা মেনে চলতে হবে। বস্তুত ছাত্রজীবন নিয়মানুবর্তিতার একটি প্রকৃষ্ট প্রয়ােগক্ষেত্র এবং উপযুক্ত সময়। সুপারকল্পিত এবং সুসামঞ্জস্য নিয়মাবলির অধীনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ছাত্রজীবন ও ব্যক্তিজীবন পরিচালিত হলে সে জীবনের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু জীবনের প্রস্তুতি পর্বেই যদি নিয়ম-ভঙ্গের চর্চা ঘটে তাহলে তার জন্য ভবিষ্যতের গােড়া সমাজকেই চরম মাশুল দিতে হয়। ছাত্রজীবন ভবিষ্যতেরই এক বিশেষ অধ্যায় মাত্র। পরবর্তী জীবনে ছাত্রই দায়িত্বশীল নাগরিক, প্রগতিশীল সমাজকর্মী ও জাতির সুযােগ্য কর্ণধার । তাই ছাত্রসমাজের কাছে নিয়মানুবর্তিতা এক মহৎ কর্তব্য। অতএব, জীবন গঠনের উষালগ্নে শৃঙ্খলাবােধের বীজ বপন করলে ভবিষ্যৎ জীবনে তাতে সাফল্যের সােনা ফলে।
ব্যক্তিজীবনে নিয়মানুবর্তিতা : প্রতিটি মানুষই জীবনে সাফল্যকে আত্মস্থ করতে চায়। কিন্তু এ সাফল্য তখনই ধরা দেয় যখন মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মের অনুশাসনকে মেনে চলে। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনাচরণ ও কর্মসাধনার মধ্য দিয়েই ব্যক্তিগত জীবনের উৎকর্ষ সাধিত হয়। একজন মানুষ যদি সকালবেলা বিলম্বে ঘুম থেকে জাগরিত হয় তাহলে তার সারাদিনের কর্মপরিধিই ওলটপালট হয়ে যায় এবং দিন শেষে কাজের জট পাকিয়ে যায়। ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রণে সমাজ যে সমস্ত রীতির প্রচলন করেছে এবং রাষ্ট্র যেসব বিধিবিধানকে আইন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে সেগুলাের নিয়মসিদ্ধ প্রতিপালন একজন ব্যক্তিকে সুনাগরিক হিসেবে মর্যাদা দেয়। মােটকথা, ব্যক্তিগত জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে নিয়মানুবর্তিতার চর্চাই হলাে একমাত্র পন্থা।
নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তরায় নয় : সমাজ মানুষের স্বার্থেই বিভিন্ন নিয়মের সৃষ্টি করেছে। এসব নিয়মের প্রতিপালককে কেউ কেউ ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি বলে মনে করে। আসলে এ ধারণা আদৌ সত্য নয়, বরং নিয়ম মানার মাধ্যমে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অপরের অধিকারকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। নিয়মবিধি মানুষের জীবনকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। ব্যক্তিস্বাধীনতা মানে ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীনতা নয়। স্বাধীনতার যে সীমা ও দায়িত্ব রয়েছে, তাতেই নিয়ম-শৃঙ্খলার আদর্শ সমুন্নত থাকে। সুতরাং সামাজিক নিয়ম ব্যক্তির জীবনকে স্বাভাবিক বিকাশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, ব্যক্তিকে অবদমিত করে না। নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব : পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, জাতীয় জীবন অর্থাৎ মানবজীবনের সব ক্ষেত্রেই নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়মানুবর্তিতার অভাব ব্যক্তিজীবনকে ব্যর্থ ও হতাশাগ্রস্ত করে। সমাজজীবনকে করে বিশৃঙ্খল ও শান্তিহীন। জাতীয় জীবনের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলাের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সুশৃঙ্খল নিয়মই তাদের উন্নতির প্রধান কারণ। নিয়মানুবর্তিতার অভাবে অনেক প্রতিভাবান মানুষকেও জীবনে ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে। মূলকথা হচ্ছে, সার্থক-জীবনের জন্য নিয়মানুবর্তিতার কোনাে বিকল্প নেই।
উপসংহার: আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত যে, সুশৃঙ্খল নিয়মের মাধ্যমে জীবনকে গড়ে তুলতে হবে। কেননা সানবর্তিতাই আমাদের এমন একটি জীবনপ্রণালি দান করতে পারে- যা মঙ্গলকামী, কল্যাণকর এবং সর্বোপরি সুন্দর । রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের ভাষায়, যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, এক্যের বিধান আছে, সকলের স্বতন্ত্র স্থান ও অধিকার আছে, সেই সমাজেই পরক আপন করিয়া লওয়া সহজ। সুতরাং ব্যক্তি তথা জাতীয় জীবনে উন্নতির জন্য সর্বস্তরে কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন করা একান্তই বাঞ্ছনীয়।
রচনা টা খুবই সুন্দর হয়েছে ।