ভাব-সম্প্রসারণ : স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনাে শেখেনি বাঁচিতে

স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনাে শেখেনি বাঁচিতে
স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনাে শেখেনি বাঁচিতে

স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ 
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনাে শেখেনি বাঁচিতে।

অথবা, যা রাখি আমার তরে মিছে তারে রাখি, আমিও রব না যবে সেও হবে ফাকি, 
যা রাখি সবার তরে, সেই শুধু রবে, মাের সঙ্গে ডােবে না যে, রাখে তাতে সবে। 

ভাব-সম্প্রসারণ : মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে সকলের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই জীবনের পরম সার্থকতা নিহিত। অন্যদিকে স্বার্থপর মানুষ, যে নিজেকে নিয়েই সদা ব্যস্ত থাকে, তার এ বেঁচে থাকার মধ্যে কোনাে । সার্থকতা নেই। 

আত্মসর্বস্ব মানুষ শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকে, এদের মনুষ্যত্বের মৃত্যু অনেক আগেই ঘটেছে। নিজ স্বার্থ-চরিতার্থ করা মানুষের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যায় জগৎ-সংসারে আত্মমােহে আচ্ছন্ন অসংখ্য মানুষ। ভােগ আর বিলাসে গড়ে ওঠে তাদের সাধের বিশাল ইমারত। পার্থিব ভােগবস্তু সংগ্রহ আর সঞ্চয়ের নেশায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এরা শুধু লাগামহীন ঘােড়ার মতাে ছুটে চলে। এদের এত পাওয়ার পরও আকাক্ষার শেষ হয় না। ব্যক্তিগত জীবনের জন্য সুখ-শান্তি আর আরাম-আয়েসের জন্য এদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আবার সুখের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তােলে তাতে অন্য কারাে প্রবেশের অধিকার নেই। এই আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সহসা এরা বেরিয়ে আসতে পারে না। একমাত্র নিজ সুখের জন্য এ শ্রেণির মানুষকে অপরিসীম লােভ-লালসা অক্টোপাসের মতাে চারদিক থেকে বন্দি করেছে। শুধু ভােগ্যবস্তু, সুখ-শান্তি, আরাম-স্বাচ্ছন্দ্য জীবনকে সুন্দর আর মধুময় করতে পারে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা আরাম ও সুখকর হলেও এ জীবনে কখনােই প্রকৃত সুখ আসতে পারে না। ব্যক্তিস্বার্থ বরাবরই ক্ষুদ্র, সীমিত এবং গণ্ডিবদ্ধ, তাই বৃহৎ জীবনের স্পর্শ এখানে নেই; দেশ ও দশের উপকারের চিন্তাও এখানে অনুপস্থিত। সুতরাং স্বার্থপর ব্যক্তির জীবন নিরর্থক, নিস্ফলা ভূমিতে পরিণত হয় । কিন্তু এ জন্য মানুষ পৃথিবীতে আসেনি। কালস্রোতে পৃথিবীর সবকিছুই বিলীন হয়ে যায়, তারপরেও তাদের নাম কখনাে মুছে যায় না। যারা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অপরের উপকার সাধন করেছেন। পৃথিবীতে এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানুষের কল্যাণে কত জ্ঞানী, গুণীর যে মহকর্মে বিশ্ব আজ সভ্যতার চূড়ান্ত শিখরে পৌছেছে—তাদের কজনের নামই বা জানি। অথচ তারা নীরবে-নিভৃতে জীবনের সকল সুখ-শান্তিকে পরিহার করে সকলের জন্য কাজ করেছেন। তাঁদের এই মহকর্মেই তাঁরা চিরস্মরণীয়। 

নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে, স্বার্থপর মানুষ নিজেও আনন্দ পেতে পারেন। নিজ-স্বার্থ নয় বরং বৃহৎ স্বার্থে সকল মানুষের কাছাকাছি আসতে পারেন। আর তখনই জীবনের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়, মানুষ হিসেবে বাঁচতে শেখা যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url