বাংলা রচনা : আমার প্রিয় শিক্ষক
আমার প্রিয় শিক্ষক
অথবা, তােমার জীবনে যে মানুষ
[ সংকেত : ভূমিকা; প্রথম পরিচয়; যে অমূল্য সম্পদ পেয়েছি; আদর্শ ব্যক্তিত্ব; তিনি আদর্শ শিক্ষক হওয়ার কারণ; দায়িত্ববােধ ও | কর্তব্যপরায়ণতা; অনবদ্য অসীম অবদান; অনুভূতিপ্রবণতা; উপসংহার ।]
ভূমিকা ; কালের যাত্রার ধ্বনি অনুরণিত হয়ে ওঠে শিক্ষকের কণ্ঠে। জ্ঞানের রাজ্যে আমার পদচারণার শুভ উদ্বোধন ঘটেছে শিক্ষকের পুণ্য করম্পর্শে অবাধ বিচরণ চলছে তাদের ক্রমাগত দিক নির্দেশনায়। জীবন সুগঠনের মন্ত্র পেয়েছি তাঁদের বাণী থেকে। তারা সংখ্যায় অনেক কিন্তু স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তাঁরা বৈচিত্র্যে ভিন্নতর, কিন্তু আকর্ষণে অনন্য। তবু তাঁদের আলাের মিছিল থেকে একজনকে আমি প্রিয় বলে পৃথক করতে পারি। আমার প্রিয় শিক্ষকের নীতি-নির্দেশনা, চিন্তা-চেতনা-আদর্শ আমার জীবনে চলার । পথের পাথেয় হিসেবে বিবেচিত। তার জীবনবােধ ও প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেই আমি আজ আলাের পথের যাত্রী । তার মহান সান্নিধ্য লাভ করতে পেরে সত্যিই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
প্রথম পরিচয় : আমার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর্বটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত অনেক শিক্ষকের সাহচর্য আমি পেয়েছি। তাদের থেকে আমি অনন্ত জীবনের পথ চলার পাথেয় সঞ্চয় করেছি। তাদের সকলের কাছেই আমি ঋণী। তবে যে শিক্ষক আমার হৃদয় মানসে ধ্রুবতারার মতাে জেগে আছেন, তিনি হলেন। বরিশাল জেলার অন্তর্গত আগৈলঝাড়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত গৈলা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জনাব বিজন কুমার বৈরাগী । আমি জানি, তিনি কোনাে দেশ বিখ্যাত ব্যক্তি নন, দেশজোড়া তার কোনাে পরিচিতি নেই, কিন্তু আমার মতাে অনেক ছাত্রের হৃদয়ে তিনি কিংবদন্তি পুরুষ। বিজন স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। আমার মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন স্যার ক্লাসে পড়িয়েছিলেন পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের 'কবর' কবিতাটি। স্যারের শ্রুতিমধুর ভরাট কণ্ঠে কবিতার লাইনগুলাে শুনতে শুনতে আমার চোখ জলে ভরে উঠেছিল।
যে অমূল্য সম্পদ পেয়েছি : স্যার আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মােচন করে দিয়েছিলেন। সাহিত্য ছিল তার আলােচনার বিষয়। রসহীন পাঠ্য বিষয়বস্তুকেও তিনি সুমধুর করে তুলতেন। তাঁর ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। তার অসাধারণ বাচনভঙ্গি, বােঝানাের ক্ষমতা এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ মন্ত্রমুগ্ধের মতাে করে রাখত ছাত্রছাত্রীদের। স্যার সাহিত্যের সঙ্গে আমার ক্ষীণ পরিচয়কে সুদৃঢ় করে তুললেন। ক্লাসে আমি ছিলাম বিজন স্যারের প্রিয় ছাত্র। সন্তানের মতাে ভালােবাসতেন তিনি আমাকে। আমাদের পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অতিথি । প্রায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। কীভাবে পড়াশুনা করছি, কী করলে আরও ভালাে করতে পারব এসব পরামর্শ ও নির্দেশনা সবসময়ই তার কাছ থেকে পেয়েছি । বিভিন্ন বিষয়ের প্রচুর বই ছিল তার সংগ্রহে। সেসব বই একটি একটি করে স্যারের কাছ থেকে এনে পড়েছি- এতে করে আমার সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। এছাড়াও স্যারের কাছ থেকে জীবন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার ইতিবাচক নির্দেশনা পেয়েছি। মানবিক গুণাবলি চর্চা করার অনুপ্রেরণা লাভ করেছি তার কাছ থেকেই। শিক্ষা যে শুধু একমুখী একটি বিষয় নয়, বরং শিক্ষা মানুষের জীবনের বহুমাত্রিক বােধের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটায়, তা স্যারের কাছ থেকেই শিখেছি। তার পিতৃতুল্য আদর, স্নেহ, শাসন প্রভৃতি আমাকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রবল অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। মােটকথা, জীবনে আমি যা কিছু জেনেছি, যা কিছু শিখেছি, তার সবকিছুর পেছনে আমার প্রিয় শিক্ষক বিজন স্যারের অনবদ্য অবদান রয়েছে।
আদর্শ ব্যক্তিত্ব : বিজন স্যার আমার শুধু প্রিয় শিক্ষকই নন, তিনি হলেন আমার জীবনের আদর্শ ব্যক্তিত্ব। স্যার উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকতার মহান পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন । উপযুক্ত শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্রদের সচেতন করে তােলাই ছিল তাঁর জীবনের মহান ব্রত। তার গড়ন ছিল মাঝারি আকারের এবং গায়ের রং ছিল শ্যাম বর্ণের। তিনি ছিলেন সদালাপী এবং মিষ্টভাষী। তিনি পড়ালেখার ব্যাপারে ছাত্রদের প্রতি যেমন কঠোর ছিলেন তেমনি ছিলেন দরদি। পাঠ্যবিষয়কে তিনি মনােযােগের সাথে আত্মস্থ করতেন এবং শ্রেণিকক্ষে তা অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সততার প্রতিমূর্তি। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে সবাই নত হতে বাধ্য ছিল। মানবতাবাদী, মুক্তচিন্তার অধিকারী, সংস্কৃতিসেবী আমার এ প্রিয় শিক্ষকের আদর্শকে আমি আমার জীবনের আদর্শিক মুকুট হিসেবে তুলে নিয়েছি।
তিনি আদর্শ শিক্ষক হওয়ার কারণ : যৌক্তিক কারণেই তিনি ছিলেন আমার কাছে একজন আদর্শ শিক্ষক। সুশিক্ষা দানের জন্য স্যার ছাত্রদের চেয়ে বেশি লেখাপড়া করতেন। কথায় আছে, সুশিক্ষিত লােক মাত্রই স্বশিক্ষিত। বস্তুত বিজন স্যার ছিলেন পরিপূর্ণ স্বশিক্ষিত সৃজনশীল মানুষ। অন্যান্য শিক্ষকের তুলনায় সবসময় তিনি ছাত্রদের পড়ালেখার ব্যাপারে সুপরামর্শ দিতেন। কোনাে ছাত্র তার কাছে গেলে তিনি মােটেই বিরক্তবােধ করতেন না, বরং যত্নসহকারে তার সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি নিজ আদর্শের ভেতর দিয়ে যে বীজ বপন করে গেছেন তা আজ আমার মতাে অনেকের ব্যক্তিজীবনেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ছাত্রদের চিত্ত জয় করার এক জাদুকরী শক্তি ছিল তার মধ্যে। আর এ শক্তির মূল উৎস ছিল তাঁর আদর্শনিষ্ঠ জীবন।
দায়িত্ববােধ ও কর্তব্যপরায়ণতা : একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাগুণ বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ববােধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা বিশেষভাবে বিবেচ্য। তিনি সঠিক সময়ে স্কুলে আসতেন এবং ক্লাস নিতেন। স্কুলের গণ্ডির বাইরেও তিনি ছাত্রছাত্রীদের পারিবারিক খোঁজ-খবর রাখতেন। শৃঙ্খলাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দান করতেন। সদাচরণকে তিনি সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। সততা ও আন্তরিকতাকে তিনি জীবনের সাফল্যের উপায় ভাবতেন। সময়ানুবর্তিতাকে তিনি মনে করতেন জীবন গঠনের অনিবার্য উপাদান। শ্রেণিকক্ষে তিনি প্রায় সবাইকে নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু পরীক্ষার হলে আমাদের চিনতেন না। একটি অসদাচারণমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষার জন্য তিনি যে গাম্ভীর্যের নির্মোক গ্রহণ করতেন তা আমাদের মনে ভীতি নয়- পরম শ্রদ্ধার উদ্রেক করত। তার এ ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতা তাঁকে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় করে তুলেছে।
অনবদ্য অসীম অবদান : বিজন স্যারের অবদানের পুষ্পবৃষ্টি পাঠের আঙিনা ছাড়িয়ে আমার জীবনের নানা দিককে সুরভিত করে তুলেছে। স্যারের কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি তা অতুলনীয়। তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার মৌলিক ভিত্তি অর্জন করে আমি ব্যাবহারিক জীবনে সে ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছি। মানবতার জয়গান’ ছিল স্যারের দর্শনের অন্যতম বিষয়। তাই মানবতার মহান সত্যে ব্রতী হয়ে তিনি তার জীবনের সকল প্রকার বিত্ত-বিলাসকে বিসর্জন দিয়েছেন। মানুষকে তিনি ভালােবাসতেন, দুর্দিনে সাহায্য করতেন, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতেন। জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে আগ্রহ জাগিয়ে তিনি যে মহৎ অবদান রেখেছেন, সে পথে চলেই আজ আমার জীবনের এই সাফল্য অর্জনের অগ্রসরতা।
অনুভূতিপ্রবণতা : চিরন্তন নিয়মে সময় বদলে যায় । কিন্তু সময়ের পিঠে রচিত ঘটনা থেকে যায় মানুষের মাঝে । স্যারের কথা মনে পড়লে আমার মনটা হু হু করে ওঠে। শুনেছি তিনি এখন অবসর গ্রহণ করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন অথচ এ স্যার কে স্কুলে দেখেছি প্রাণবন্ত যুবক হিসেবে। কর্মচাঞ্চল্য আর উদ্দাম আবেগধারী স্যারের প্রতিচ্ছবি এখনও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। ছাত্রদের জন্য তার আবেগ, উচ্ছ্বাস, দরদ সত্যিই দুষ্টান্তমূলক । যেদিন স্কুল ছেড়ে চলে এসেছিলাম সেদিন স্যার আমাকে ধরে শিশুর মতাে অঝােরে কেঁদেছিলেন। আশীর্বাদ করেছিলেন বলেছিলেন, “জীবন ও জীবিকার প্রয়ােজনে যে যাই হও না কেন সবার আগে যেন মানুষ হও । জানি না কতটা মানুষ হতে পেরেছি। তবে যতটুকু পেরেছি তা আমার প্রিয় শিক্ষকের জন্যই সম্ভব হয়েছে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সত্যিই অনুভূতিপ্রবণ এমন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্বকে আমার আদর্শ হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত।
উপসংহার : চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ধীশক্তিসম্পন্ন আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক । তিনি ছিলেন সত্য ও সুন্দরের উপাসক। তার সুবিশাল.চিত্তে ভালােবাসার যে ফল্পধারা বহমান তা মানুষের মধ্যে জীবনভর বিলিয়ে দিলেও ফুরাবে না। এ পর্যন্ত যত শিক্ষকের সংস্পর্শে এনেছি বিজন স্যারের মতাে, এমন আদর্শবান শিক্ষক আমি দেখিনি। আমার প্রিয় শিক্ষক আমার কাছ থেকে। বাস্তবতার কারণে দূরে থাকলেও তিনি আমার চিন্তার জগৎজুড়ে রয়েছেন। তার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা নিরন্তর বিরাজমান। আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের জন্য গর্ববােধ করি। স্যারের সেই মন্ত্রধ্বনি আবৃত্তি আজও আমার কানে বাজে চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির'... । আমার প্রিয় শিক্ষক চিরদিন আমার জীবনাকাশে আদর্শের মূর্ত তারকা হয়ে প্রজ্জ্বলিত থাকবেন। আমি গভীর শ্রদ্ধা ও পরম ভালােবাসায় স্রষ্টার কাছে আমার প্রিয় স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
প্রিয় গ্রাম