বাংলা রচনা : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
[সংকেত : ভূমিকা; সাম্প্রদায়িক মনােভাব; উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা; সাম্প্রদায়িকতার কালাে ছােব সাম্প্রদায়িকতার প্রসার; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়ােজনীয়তা: সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের উপায়; উপসংহার।]
ভূমিকা : কবি বলেছেন- ‘ জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে। সে জাতির নাম মানবজাতি।’ আদি মানব গােষ্ঠীর মধ্যে শুধু একটি জাতিই ছিল- যেটি মানবজাতি। কালক্রমে মানবজাতি ধর্মীয় কারণে হয়ে গেল- মুসলমান, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ বহু জাতি জাতিভেদের কারণে তাদের মধ্যে তৈরি হয় সংকীর্ণতা হানাহানি প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসী মনােভাব। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বােধবিবেক- এগুলাে দিয়েই তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হলাে জাতিগতভাবে সদ্ভাব বা সৌহার্দ বজায় রাখা।
সাম্প্রদায়িক মনােভাব : সাম্প্রদায়িকতা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে। সৃষ্টি করে মানুষের মনে অমানবিক বিদ্বেষ ও ঘৃণা। তাই সাম্প্রদায়িকতা কোনাে শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটায় না। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ফলে হত্যা, দাঙ্গা, লুণ্ঠন প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সুত্রপাত ঘটে। সম্প্রতি সভ্যতার অগ্রগতিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি কঠিন বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষে মানুষে কোনাে ভেদাভেদ নাই’- সাম্প্রদায়িকতার ফলে এই নীতি বাক্য আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। নানা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সমাজের নেতৃস্থানীয় কিছু লােক সাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। এর মধ্যে রাজনীতিক উদ্দেশ্যই প্রধান। একশ্রেণির লোেক মনে করেন ধর্মের মতাে স্পর্শকাতর বিষয়কে নাড়া দিতে পারলেই উদ্দেশ্য হাসিল হবে। এক ধর্মের লােক অন্য ধর্মের লোেককে শাসন করে অথবা শাসন করবে এটা কিছু মানুষ কোনােভাবেই মেনে নেয় না। এটা হয়তাে বা তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য। ফলে শুরু হয়ে যায় গােলমাল, দাঙ্গা, মারামারি, খুনাখুনি প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কাণ্ডকারখানা। আর তখনই রাজনীতিবিদরা ঘােলাজলে মাছ শিকার করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। নিজেদের বিদ্বেষমূলক রাজনীতিতে পাকাপােক্ত করে তােলেন।
উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা : উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। ভারতবর্ষে সব জাতিই প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করত। ভারতবর্ষ বৌদ্ধ রাজা যেমন শাসন করেছে তেমনি হিন্দু রাজাও সুশাসন বাজায় রেখে শাসন করেছে। আবার বাদশাহ্রাও অর্থাৎ মুসলমান শাসকরাও সম্প্রীতি বাজয় রেখে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। তবে সকল শাসকের আমলেই খারাপ লােক ছিল বিধায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে। এগুলাে মন্দির-মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতার কালাে ছােবল : সাম্প্রদায়িকতা মানব সমাজে কোনাে সময় সুফল বয়ে আনে না বরং মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অশান্তির বিষবাষ্প ছড়ায়। এর ফলে দেশের আর্থনীতিক উন্নতি, রাজনীতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি মুখ থুবড়ে পড়ে। মানুষ শান্তি র বাঁশি ছেড়ে অশান্তির বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। প্রতি মুহূর্তেই মানুষ নিরাপত্তাহীনতার কবলে জর্জরিত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার যুপকাষ্ঠে অগণিত শিশু, কিশাের, যুবক, বৃদ্ধ বলি হচ্ছে। পৃথিবীকে স্বর্গ করার প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে মানুষ যেন আজ তা শ্মশান করার ব্রত গ্রহণ করেছে।
বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার প্রসার : ভারত, পাকিস্তান, যুগােশ্লাভিয়া, প্যালেস্টাইন, সাইবেরিয়া, বসনিয়া হারজেগােবিনা, মায়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হচ্ছে। তবে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের বিরুদ্ধে দাঙ্গার দৃশ্যগুলাে চোখে পড়ার মতাে। ইসরাইলের ইহুদি সম্প্রদায় বছরের পর বছর ধরে প্যালেস্টাইনি মুসলমানদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। মায়ানমারে নির্যাতিত হচ্ছে সব রােহিংগা মুসলমান। ভারতের দৃশ্যও তাই। পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নির দাঙ্গাতাে লেগেই আছে। এভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একের পর এক বেড়েই চলেছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়ােজনীয়তা : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপিত না হলে দেশে রাজনীতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়ােগের মাধ্যমে কোনাে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানােও সম্ভব হয় না। ফলে জনসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয় না। বহিঃশত্রুর আক্রমণের তীব্র ভয় থাকে। দেশের মানুষের মনে তখন শুধু বিদ্বেষ গড়ে ওঠে। প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপে দেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নের জন্য তা প্রধান বাধা হয়ে থাকে। দেশকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা আবশ্যক।
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের উপায় : কোনাে কোনা ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এদের চিহ্নিত করে জনগণের কাছে এদের মুখােশ খুলে দেওয়াসহ কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। দেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লােকদেরই প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে এবং দেশে তখন শান্তি শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার : সাম্প্রদায়িকতা বিশ্ব বিবেকের কাছে নিঃসন্দেহে একটা ঘৃণার ব্যাপার। মানবকল্যাণ পরিপন্থি এবং সভ্যতা বিধ্বংসী কদর্যরূপের সাম্প্রদায়িকতা কোনােক্রমেই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। দেশের জনগণ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এলে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা সম্ভব হবে। সাম্প্রদায়িকতা অপসারিত হলেই মানব জাতি শান্তিপূর্ণভাবে পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে।